ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিদিন আসছে কোটি টাকার মাদক

মিয়ানমার থেকে ট্রলারে মাছের আড়ালে আসছে ইয়াবা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

মিয়ানমার থেকে ট্রলারে মাছের আড়ালে আসছে ইয়াবা

শংকর কুমার দে ॥ মিয়ানমার থেকে সমুদ্রপথে ট্রলারযোগে মাছের আড়ালে মরণ নেশা ইয়াবার চোরাচালান আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত ইয়াবা কারখানা। চলতি এপ্রিল মাসেই দেশে এসেছে প্রায় ত্রিশ কোটি টাকার ইয়াবার চোরাচালান। প্রতিদিনই দেশে প্রায় এক কোটি টাকার ইয়াবার চোরাচালান আসছে, যা প্রতিবছরে ইয়াবার চোরাচালান আসার পরিমাণ দাঁড়ায় তিন শতাধিক কোটি টাকা। বাংলাদেশে মাদকসেবীদের কাছে হেরোইন, ফেনসিডিলকে পেছনে ফেলে মরণ নেশা ইয়াবাই দখল করে নিয়েছে মাদকসেবীদের সর্বাধিক সংখ্যাটি। এ জন্য ইয়াবা পাচার রোধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করার পরও কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার চোরাচালান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার কারখানাগুলো ও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। ইয়াবা চোরাচালানে ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগর পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আমদানি করা গাছের মধ্যে খোড়ল কেটে ও মাছের প্যাকেটের মধ্যে ইয়াবা আনা হয়। ইয়াবা গডফাদাররা এখন সরাসরি বস্তাবন্দী অবস্থায়ই ইয়াবা আনা শুরু করার খবর পাওয়া গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে ২০ লাখ ও টেকনাফ থেকে আসা ১০ লাখ ইয়াবার দুই বড় চালানের আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপকেন্দ্রিক দেশের সর্ববৃহৎ একটি আন্তর্জাতিক ইয়াবা পাচার চক্রের সদস্য হাবীব মেম্বার, কালা জামাল, ওয়াহিদুর রহমান, ওয়াহিদুজ্জামান, সাইফুল করিম, জেট করিমসহ ৯ জনকে আটক করেছে র‌্যাব। গত ৪ মাসে মোট ৭৬ লাখ ইয়াবার ৪টি চালান এনেছে ইয়াবা চোরাচালানি চক্র। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসে ১৬ লাখ এবং জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে তিন চালানের প্রতিটিতে ২০ লাখ করে আরও ৬০ লাখ ইয়াবা খালাস করেছে তারা। চার দফা ইয়াবা পাচারে সক্ষম হলেও পঞ্চম দফায় গ্রেফতার হয় ইয়াবা চোরাচালানের সম্রাট মোজাহার। মোজাহারকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ইয়াবা চোরাচালানের নেপথ্যের অনেক অজানা কাহিনী। এই মোজাহার সামান্য খুদে ব্যবসায়ী থেকে ইয়াবা চোরাচালানে নেমে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতোই ক্রোড়পতি বনে গেছেন। সম্প্রতি কক্সবাজারের কলাতলীর ইয়াবা ব্যবসায়ী মফিজ ও টেকনাফের নুর মোহাম্মদ বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্র এলাকায় টহল বেড়ে যাওয়ায় ইদানীং এ চক্রটি টেকনাফ থেকে গভীর সমুদ্র হয়ে বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী ও হাতিয়া উপকূলে ইয়াবার চালান নিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে মোজাহার বলেছেন, শুধু আমিই (মোজাহার) নই, ইয়াবা পাচারকারী টেকনাফের হাবীব, কালা জামাল, সাতকানিয়ার ওয়াহিদুর রহমান, কক্সবাজার শহরের ওয়াহিদুজ্জামান, টেকনাফের সাইপুল করিম, জেট করিম ও চট্টগ্রামের মোজাহার চক্রটি ইয়াবা পাচারের মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন। ঢাকা থেকে চারজনের এ সিন্ডিকেট মাছ ধরার ট্রলারযোগে প্রতি সপ্তাহে কক্সবাজারের সমুদ্রপথে লাখ লাখ ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী ও হাতিয়া উপকূলে। এসব চালান খালাস হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকার গুলশান, বনানীসহ অভিজাত পাড়ায়। আর সাগরপথে ইয়াবা পাচারে জড়িত হাবীব-জামাল-ওয়াহিদ মাফিয়া চক্রের খোঁজে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশে ইয়াবার চাহিদা দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাচার হয়ে আসা মাদকের মধ্যে বেশি আসছে ইয়াবা, তারপর আসছে ফেনসিডিল ও হেরোইন। তবে এসব মাদকের কোনটিই দেশের ভেতর উৎপাদন হয় না। এগুলো আনতে গিয়ে নিঃসন্দেহে দুর্বৃত্তরা দেশের বাইরে পাচার করছে বিপুল অঙ্কের টাকা। কক্সবাজার- টেকনাফের উপকূলের স্থল ও সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই আসছে একের পর এক বড় বড় ইয়াবার চালান। এর মধ্যে ১৬ এপ্রিলের ২০ লাখ ইয়াবা চালানটি ছিল দেশে ইয়াবার চালানের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ইয়াবা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিরো টলারেন্স নীতি বলবৎ থাকলেও সাগরপথে ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা পাচার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সড়কপথে পাচারের পাশাপাশি এখন ইয়াবার বড় বড় চালান আসছে সাগরপথে। আর পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে শক্তিশালী ইয়াবা সিন্ডিকেট সাগর ও সড়কপথে সমান তালে ইয়াবা পাচার করছে। চলতি এপ্রিল মাসেই পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা পৃথক অভিযান চালিয়ে শত কোটি টাকার অধিক ইয়াবার চালান আটক করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের সীমান্তে গড়ে ওঠা ইয়াবার কারখানাগুলো ও ইয়াবার চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলেছে। কূটনৈতিক ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ইয়াবা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা হয়েছে, যা এখনও অব্যাহত আছে। মিয়ানমার সীমান্তের ইয়াবা কারখানাগুলো ও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধে সম্মত আছে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। ইয়াবা চোরাচালান ও ইয়াবা কারাখানা বন্ধের বিষয়ে একটি সমাধানে পৌঁছানো যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
×