ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না

জাতিসংঘ ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশে সাড়া নেই মিয়ানমারের

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

জাতিসংঘ ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশে সাড়া নেই মিয়ানমারের

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘ ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষা করে চলেছে মিয়ানমার। বিশেষ করে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আনান কমিশন গঠিত হলেও ওই কমিশনেরই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেই দেশটির। বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যেই বেশকিছু রোহিঙ্গা নাগরিক নিজ দেশে ফিরে গেলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধানে এখনও কোন আন্তরিকতা মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দেখানো হয়নি। এছাড়া জাতিসংঘের সুপারিশ মানতে নারাজ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী আউং সান সু চি। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সু চির উদ্যোগে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন এক মাস আগে একটি অন্তর্বর্র্তীকালীন প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারকে পরিচয় যাচাইয়ে একটি সমন্বিত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয় কমিশন। এছাড়া বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়াসহ দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে একটি যৌথ কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়। আন্তর্জাতিক আইন মেনে যৌথভাবে পরিচয় যাচাই শেষে মিয়ানমারের লোকজনকে দেশে ফেরার পথ সুগম করবে এই যৌথ কমিশন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া ও তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতের পাশাপাশি সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীদের অবাধে রাখাইন এলাকায় যাওয়ার জন্যও সুপারিশ করে কমিশন। আনান কমিশন সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি যৌথ কমিশন গঠন করা জরুরী। এই যৌথ কমিশন আন্তর্জাতিক আইন মেনে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার পাশাপাশি মানব, মাদক ও অবৈধ বাণিজ্য, অবৈধ অভিবাসন বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও সহযোগিতা বাড়াবে। তবে এখনও ওই কমিশন গঠনের বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার। কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশকালে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান তখন সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, এখন সময় হয়েছে শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার। সেই সঙ্গে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবস্থা, রাখাইন এলাকার সহিংসতা, বাস্তুচ্যুতি এবং উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজে নিয়ে তা বিশ্লেষণের জন্য মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সু চি ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ওই কমিশন গঠন করেন। কফি আনানের নেতৃত্বে নয় সদস্যের ওই কমিশনের ছয়জন মিয়ানমারের বিশিষ্ট নাগরিক। এই কমিটির সদস্যরা মিয়ানমারের পাশাপাশি বাংলাদেশও সফর করেন। প্রতিনিধি দল সফর শেষে গত ১৮ মার্চ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে মিয়ানমারের সু চি সরকারই এ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে এখনো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এছাড়া কমিশন আগামী আগস্টের শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে। এদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের হত্যা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ঘটনাগুলো একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করার সুপারিশ করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করে গত ১৩ মার্চ একটি প্রতিবেদন পেশ করে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাখাইন প্রদেশে পাঁচ মাস ধরে সেনা অভিযান চলছে। সেখানে ব্যাপক হারে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে বলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমরা অভিযোগ করছেন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মুসলিম রোহিঙ্গাদের সংখ্যা অন্তত ৭০ হাজার। ইয়াংহি লি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তবে মিয়ানমার সফরের সময় রাখাইন প্রদেশের সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। প্রতিবেদনে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর জাতিসংঘের ওই বিশেষ দূত জানিয়েছিলেন, মিয়ানমার সফরকালে তাকে পদে পদে বাধা দিয়েছে সরকার। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে তিনি কক্সবাজারে ১৪০ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন, যারা সম্প্রতি রাখাইন থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি জানিয়েছিলেন, ঘটনার তদন্তে মিয়ানমার সরকার কয়েকটি কমিশন গঠন করলেও তা স্বাধীন নয়। কোন কোন কমিটিতে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারাও রয়েছেন, যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই বেশি। এ বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করেন তিনি। তবে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন ও সুপারিশ মানতে নারাজ মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সু চি। গত ৩১ মার্চ মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের প্রতিবেদন যথোপযুক্ত নয়। তাই সংস্থাটির মানবাধিকার পরিষদের চাপিয়ে দেয়া কোন সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করতে পারবো না। সু চি আরও বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের ব্যাপারে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমরা সেটি গ্রহণ করতে পারছি না। এর মানে এই নয় যে, জাতিসংঘের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল নই। বরং এই প্রতিবেদনের সঙ্গে মিয়ানমারের বাস্তব পরিস্থিতির কোন মিল নেই। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞের ঘটনায় মিয়ানমার সফরও করেছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। তিনি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থা পরিদর্শন করেন। সে সময় কফি আনান সেখানকার উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের বিক্ষোভের মুখেও পড়েন। কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্যরা এরপর বাংলাদেশে আসেন। আনান কমিশনের তিনজন প্রতিনিধি ২৮-৩০ জানুয়ারি ঢাকা ও কক্সবাজার সফর করেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনও করেন তারা। ঢাকায় বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরপর আনান কমিশন রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় বিভিন্ন সুপারিশ করেন। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে এই সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপও দেয়া হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে গঠিত এই দুটি কমিশনের বাস্তবায়নও আশা করছে বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও ইতিবাচক কোন সাড়া মিলছে না। উল্লেখ্য, গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় সে দেশের নয় সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১ হাজার ২০০ বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ওই সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করে তারা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে তিন লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছেন। আর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার। গত বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্তে সহিংস ঘটনার পরে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়ার জন্যও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
×