ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আঃ রউফ মোল্লা (কমান্ডার)

বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি

শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূইয়া ‘বীর উত্তম’-এর ছোট ভাই আল্লামা ইকবাল অনেক বছর পর কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি তার ছেলে এহেতেশাম ইকবালের মাধ্যমে যোগাযোগ করে বাসার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমার আমন্ত্রণে বড় ভাই লে. কর্নেল (অব) কামাল উদ্দিন ভূইয়া, যিনি বর্তমানে উত্তরার মাইল স্টোন কলেজের প্রিন্সিপাল (এডমিন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আল্লামা ইকবাল উদ্দিন ভূইয়া (কানাডা প্রবাসী), হাসান মহিউদ্দিন ভূইয়া (ব্যাংকার), একেএম রফিকুল হক বীর প্রতীক, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অব) সোনালী ব্যাংক লিঃ ও এহেতেশাম ইকবাল আমার বাসায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণমূলক অনেক আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় ১ এপ্রিল ২০১৭ আমরা সিলেটের কানাইঘাটের সেই স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে যাব এবং নিজাম ভাইয়ের কবর জিয়ারত করব। ১ এপ্রিল ভোর পাঁচটায় আমরা সিলেটের উদ্দেশে রওনা হই। সিলেটের এমসি কলেজ গেট থেকে সোলায়মান চেয়ারম্যান (সাবেক) আমাদের সাথী হলেন। তার কানাইঘাটের বাড়িতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। ভদ্রলোক পাথরের ব্যবসা করেন। সিলেটে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুরে এসে পরে খাব। গাড়ি দ্রুত গতিতে চলছে, যদিও রাস্তা তেমন ভাল নয়। আমরা সড়কের বাজারে এলাম। কানাইঘাট থেকে আমাদের সহযোদ্ধা আনোয়ার সঙ্গী হলেন। দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর পর সহযোদ্ধাকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হলাম। ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে মোবাইলে আলাপ হতো। পরবর্তীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছে। সুরমা নদীর দুই পারেই ওর বাড়ি আছে। আনোয়ারের কাছ থেকে জানতে পারলাম শরিফ সড়কের বাজারে আছে। শরিফ আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল। এই শরিফ মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এই সড়কের বাজার আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে চিরদিন। একটু এগোলেই চোখে ভেসে উঠল সেই ঐতিহাসিক ব্রিজটি, যা কটালপুরের ব্রিজ নামে পরিচিত। সিলেট থেকে সড়কের বাজার হয়ে জকিগঞ্জ যাওয়ার পথেই কটালপুরের ব্রিজ। এই সেই ব্রিজ যা ধ্বংস করতে গিয়ে ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আমাদের কমান্ডার, আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব খাজা নিজাম উদ্দিন ভূইয়া শহীদ হন। এই ব্রিজ থেকে হাতের ডানে অর্ধকিলোমিটার পূর্ব দিকে আমার নেতৃত্বে কাটআপ পার্টির পজিশন ছিল ব্রাহ্মণ গ্রামের তোফাজ্জল আলীর বাড়িতে। আনোয়ার সেই বাড়িটি দেখাল। আমাদের পজিশনের পেছনের একটি বাড়িতে পাকসেনার গুলিতে একটি মেয়ে মারা গিয়েছিল। মেয়েটির বুকে গুলি লেগেছিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার ও মোকলেছ রেকি করতে গেলে এখানেই অবস্থান করে। মেয়েটির মৃত্যুর ২-৩ ঘণ্টা আগে তাদের পিঠা বানিয়ে খাইয়েছিল। ইচ্ছা ছিল ওই বাড়িটিতে যাওয়ার। কিন্তু বৃষ্টির কারণে যাওয়া হলো না। দেখতে দেখতে গাড়িটি সুরমা নদীর পাড়ে এলো। সেখানে চৌধুরীর বাড়ির সামনের মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে আমার গ্রুপসহ এই চৌধুরী বাড়িতে বিশ্রাম নিয়েছিলাম। নদীর পারের চায়ের দোকানে স্থানীয় এক ব্যক্তি চা খাওয়ালেন। নৌকায় উঠে বসলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল নদীর ওপারে নক্তিপাড়া। নক্তিপাড়ার কালা মিয়া হাজির বাড়িতে আমার ক্যাম্প ছিল। হায়দার চাচা, সালাম চাচা সোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এলাকার লোকজন অনেকেই আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছেন। এলাকার লোকজনকে আপন করার চেষ্টাও আমি করেছি। বৃহস্পতিবার নক্তিপাড়ায় ক্যাম্প পরিদর্শন করেছিলাম। মনে পড়ে শুক্রবার আমি জুমার নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গেলাম। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস ছিল। মুসল্লিগণের উদ্দেশে বলেছিলাম আমি কে? কেন আমি এখানে? কেন আমার কাঁধে রাইফেল? এই তিনটা প্রশ্নের ওপর ৩৫-৪০ মিনিট বক্তব্য দিয়েছিলাম। তখন আমার চোখেও পানি এসেছিল, অনেকের চোখেই আমি সেইদিন পানি দেখেছিলাম। ২২ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর আক্রমণের সময় আহাম্মদ উল্লাহ, শরিফ, বেলুচী ডিউটিরত ছিল। ওদের চিৎকার শুনেছি। কে যেন বলল আহাম্মদ উল্লাহ শরিফ মারা গেছে। ওদের খোঁজ নেয়ার সাহস, সুযোগ হয়নি। কুলিয়াং উকিয়াং, জালালপুর এসে অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। কিন্তু আহাম্মদ উল্লাহ, শরিফ ও বেলুচীর সঙ্গে দেখা হলো না। ২২ সেপ্টেম্বর পাকসেনারা উজানী বারাপত ক্যাম্প দখল করে পেছন দিক দিয়ে নক্তিপাড়া, মন্তাজগঞ্জ, নারায়ণপুর/রাজারটিলা ক্যাম্পগুলো দখল করে নেয়। রফিকুল হক নামের এক মুক্তিযোদ্ধা সেইদিন শহীদ হন। নিজাম ভাইয়ের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। বৃষ্টির কারণে নক্তিপাড়া মন্তাজগঞ্জ বাজারে নামা হলো না। চলে এলাম নারায়ণপুর/রাজারটিলার কাছাকাছি। জৈন্তাপুরের রাজা রামসিংয়ের বিশ্রামাগার। সবুজ বনায়নে বনাঞ্চলে পরিণত হয়েছে এই টিলা। নিজাম ভাইয়ের এটাই ছিল মেইন ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে আমি গার্ড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি ৭-৮ দিন। এবার শুনলাম নারায়ণপুর/রাজারটিলাটি নাকি ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে। আনোয়ারের বন্ধু বলে পরিচিত গিয়াস আমাদের সঙ্গেই কাজ করেছে। গিয়াস সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ওর বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ানো হলো। গিয়াস আমাদের জন্য চা নাশতার ব্যবস্থা করেছে। যাওয়ার পথে খাব বলে ওকে নৌকায় তুলে নিলাম। সালাম চাচার ছেলের সঙ্গে দেখা এবং তার সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো। থাকার জন্য আমন্ত্রণও জানাল। মন্তাজগঞ্জ বাজার থেকে নিজাম ভাইয়ের স্মৃতিসৌধের পাশ দিয়ে নতুন রাস্তা হচ্ছে। রাস্তার দায়িত্বটা ওর ওপর পড়েছে। আমাদের কাছে দোয়া চাইল রাস্তাটা যেন পাকা করতে পারে। মোকামটিলায় চলে এলাম। মোকামটিলার পাদদেশে কিছুটা সমতল ভূমি, যাতে চাষাবাদ করা হয়। বৃষ্টির কারণে পানিতে ডুবে আছে। ক্ষেতের আইল দিয়ে অনেক কষ্টে মোকামটিলার পাদদেশে এলাম। এনজিওর প্রতিষ্ঠিত বড়খেড় প্রাথমিক বিদ্যালয়, যাতে লেখা রয়েছে শহীদ ‘বীর উত্তম’ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূইয়া বড়খেড় প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মোকামটিলার মাঝ দিয়ে রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ চলছে। বৃষ্টির কারণে আঠালো মাটিতে পা দেবে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে রাস্তাটি অতিক্রম করলাম। রাস্তার পাশেই শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূইয়া বীর উত্তম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হকের নামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক ২২ সেপ্টেম্বর পাকসেনার আক্রমণে শহীদ হন। দুই শহীদের নামে এই স্মৃতিসৌধ সরকারের তত্ত্বাবধানেই নির্মিত হয়। পাশে একটি জরাজীর্ণ মসজিদের পাশে দুই বীরের কবর। আমরা কবর জিয়ারত করলাম। মোকাম টিলায় আউলিয়ার মাজার রয়েছে। মোকামটিলার সঙ্গেই রয়েছে সালামের টিলা। মুক্তিযুদ্ধে সালামেরটিলায়ও ৭-৮ দিন আমার গ্রুপসহ দায়িত্ব পালন করেছি। বৃষ্টির কারণে সালামেরটিলায় যাওয়া হলো না। গিয়াসের বাড়ি আসা হলো। চা নাশতা করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হলাম। নক্তিপাড়া, মন্তাজগঞ্জ বাজার, নারায়ণপুর/রাজারটিলা, মোকামটিলা ও সালামেরটিলা কানাইঘাট উপজেলার ১নং লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের অংশ। গিয়াস এই ইউনিয়নের দুইবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিল। আমাদের সফরসঙ্গী সোলায়মানও দুই বার এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। সুরমা নদীর এপারে এসে চৌধুরী বাড়ির সামনের মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেই। তুমুল বৃষ্টির খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। কানাইঘাট উপজেলার সোলায়মান চেয়ারম্যান আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। সোলায়মান সাহেবের ভাতিজা (খুব সম্ভবত তিনি হাফেজ) আমাদের আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং খাওয়া-দাওয়া করালেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে রওনা হলাম। আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে বাংলার একঝাঁক তরুণ, যাদের বয়স ১৫-২২ বছর হবে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যে এবং বাঙালীর মুক্তির জন্য সামান্য ট্রেনিং নিয়ে জীবন বাজি রেখে দুর্ধর্ষ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। অনেকেই শহীদ হলো আবার কেউ কেউ বেঁচে গেল। ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ভাইয়েরা গবেষণা করলে সারাদেশের সঠিক তথ্য বের করা সম্ভব। আজকের প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান থাকবে, আপনারা গবেষণা করুন বহু মুক্তিযোদ্ধা এখনও বেঁচে আছেন। তাদের কাছে আপনারা সঠিক তথ্য পাবেন। সে সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজই ছিল হিট এ্যান্ড রান। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল অনেক কম। নবেম্বর/ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাই বলি আগস্ট/সেপ্টেম্বরে আমাদের সম্মুখযুদ্ধ প্রশংসার দাবি রাখে। ৪নং সেক্টর কমান্ডার মেজর সিআর দত্ত তার অধীনে সাব সেক্টর কমান্ডার মাহাবুবুর রব সাদী, সাদী ভাইয়ের টু-আইসি খাজা নিজাম উদ্দিন ভূইয়া, তার সঙ্গে গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছি ইলিয়াস, রাজ্জাক ও আমি। গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে আমার জানার কথা নয়, তবে আমার ধারণা সেক্টর কমান্ডার, সাব সেক্টর কমান্ডার, সাব সেক্টর কমান্ডারের টু-আইসি কেউই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংরক্ষণ করেননি। করে থাকলেও পাকসেনাদের ক্যাম্প দখলের কারণে হারিয়ে গেছে। জালালপুরে সংরক্ষিত থাকলেও কেউ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। আজ আমার মানসপটে যে নামগুলো ভেসে উঠেছে তারা হলো শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন বীর উত্তম (বুরিচং কুমিল্লা), আঃ রাজ্জাক (কুমিল্লা), আঃ রউফ মোল্লা (টঙ্গীবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ), ইলিয়াছ (কুমিল্লা), দীপঙ্কর গুপ্ত (টঙ্গীবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ), স্বপন (চাঁদপুর/মতলব), শহীদ আহাম্মদ উল্লাহ, শহীদ মোঃ শরীফ, শহীদ বেলুচী (অজানা), আবু বক্কর সিদ্দিক, আবু তাহের, ওয়াসেক মোল্লা (শিমুলিয়া, দোহার, ঢাকা), আনোয়ার মাস্টার, গিয়াস উদ্দিন চেয়ারম্যান, মোকলেছ, শহীদ মোঃ রফিকুল হক (সিলেট)। সোর্স হিসেবে যাদের সহযোগিতা পেয়েছি তারা হলেন হায়দার চাচা, সালাম চাচা, শরিফ। দর্পণগর তহশিল অফিসের চুন্নু মিয়া (হবিগঞ্জ) আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অব্যবস্থাপনা, অপরিপক্বতার কারণে হয়তো আমরা মুক্তিযুদ্ধের অনেক কিছু সংরক্ষণ করতে পারিনি। কিন্তু আমি মনে করি এখনও সময় আছে, আজকের প্রজন্মের তরুণ গবেষক, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক ভাইয়েরা সঠিক তথ্য বের করে শহীদদের যথাযথ মর্যাদা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করতে পারেন। আজ ৪৬ বছর পর সহযোদ্ধাদের নিয়ে অপারেশনের স্থানগুলো পরিদর্শন করে সেই বিভীষিকাময় স্মৃতিগুলো মানসপটে ভেসে উঠছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরের করুণ ও মর্মান্তিক স্মৃতির গভীরে। সহযোদ্ধা হারানো ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখে প্রশান্তি পেয়েছি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশ ও জাতির জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি বলে। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা
×