ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পবিত্র লায়লাতুল মিরাজ এক মহা মিলনের রাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

পবিত্র লায়লাতুল মিরাজ এক মহা মিলনের রাত

মানুষের হিদায়াত দান করার জন্য আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসূলকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে আমাদের প্রিয়নবী প্রেরিত হয়ে আসেন। তাঁর পৃথিবীতে তশরিফ আনয়নের মধ্য দিয়ে হিদায়েতের পূর্ণ স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বিশ্ব মানবসভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং আল্লাহর দেয়া একমাত্র জীবন ব্যবস্থা আল ইসলামের পূর্ণতা আসে। প্রিয়নবী রাসুলুল্লাহ্ (সা.) শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু। তিনি তাঁকে যাবতীয় শিক্ষাদান করে এক পর্যায়ে তাঁকে সৃষ্টির তাবত রহস্য প্রদর্শনের জন্য সমগ্র বিশ্ব জগত পরিভ্রমণ করান, এমনকি তাঁর বিরাটত্ব, মাহাত্ম্য ও কুদরতের কেন্দ্র আরশে আজিমে নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হন। এই অনন্য ঘটনা মিরাজ নামে পরিচিত। হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর পঞ্চাশ বছর বয়সকালে মিরাজ সংঘটিত হয়। মাটির পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের সকল স্তর অতিক্রম করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর সঙ্গে তাঁর একান্ত সাক্ষাত ঘটে। উল্লেখ্য, চল্লিশ বছর বয়সে তিনি প্রথম ওহী লাভ করেন। প্রথম ওহীর প্রথম উচ্চারণ ছিল ‘ইকরা’Ñ পাঠ কর। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে সেই জ্ঞানের পূর্ণতা প্রদান করেন মিরাজের মাধ্যমে। মিরাজের কয়েকটি স্তর রয়েছে। যেমন ১. কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত বুরাকে চড়ে গমন। ২. বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে নূরের কুদরতী সিঁড়ি পেরিয়ে আসমানে গমন এবং একে একে সাত আসমান পরিভ্রমণ করে বায়তুল মামুর হয়ে সিদরাতুল মুন্তাহা-সীমান্তকূল বৃক্ষ পর্যন্ত উপনীত হওয়া। ৩. সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে রফ্রফ্ নামক কুদরতী যানে মহান আরশে উপনীত হওয়া এবং আল্লাহ্র দিদার লাভ। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : অতঃপর তিনি তাঁর নিকটবর্তী হলেন মধ্যে দুহ ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন (সূরা নজম : আয়াত ৮-১০)। দিদার লাভকালে প্রিয়নবী হযরত (সা.) মহা আনন্দ-আবেগে দেহ-মনের সমস্ত প্রেম, শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান ব্যক্ত করেন এবং উচ্চারণের মধ্য দিয়ে : আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াস্ সালাওয়াতু ওয়াত্ তাইয়েবাতুÑ সমস্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান, তাবত্ ইবাদত ও পবিত্রতা আল্লাহ্র জন্য। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু এর জবাবে ইরশাদ করেন, আস্সালামু আলাইকা আয়্যুহান নাবীও ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু- হে নবী সালাম, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত আপনার প্রতি। এই সময় প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মতের কথা মনে পড়ে গেল। তখন তিনি বলে উঠলেন : আস্সালামু আলায়না ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সালিহীন- সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক আমাদের ওপর এবং আল্লার্হ নেক বান্দাদের ওপর। তিনি আরও বললেন : আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুÑ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই। জবাব এলো : ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহু ওয়া রাসুলুল্লাহ- আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহম্মদ তাঁর বান্দা ও রসূল। এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, আরশে আজীমে যখন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ও তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর মধ্যে উপরোক্ত সালাম ও সাক্ষ্য বিনিময় হচ্ছিল তখন ফেরেশতা জগতের সকল ফেরেশতা ও রুহগণ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে পাঠ করছিলেন : আল্লাহুম্মা সল্লে ‘আলা মুহাম্মাদিউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মদ।’ আমরা কুরঅন মজিদে দেখতে পাই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পেশ করেন। ওহে, তোমরা যারা ইমান এনেছো, তোমরাও নবীর প্রতি দরুদ পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে সালাম জানাও (সূরা আহযাব : আয়াত ৫৬)। সিহাহ্ সিত্তা হাদিস শরীফের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত মুহম্মাদুর (সা.) এই ঘটনার রাতে কাবা শরীফের নিকটবর্তী শিবি আবিতালিবে হযরত উম্মে হানী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহার গৃহে ঘুমিয়ে ছিলেন। গভীর রাতে আল্লাহ্র ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম কয়েকজন ফেরেশতাসহ এসে তাঁকে কাবা শরীফের হাতীমে নিয়ে আসেন এবং তাঁর বক্ষ বিদারণ করে তাঁর কল্ব মুবারককে আবে যম্যম্ দ্বারা ধৌত করে তা যথাস্থানে আবার লাগিয়ে দেন। তিনি এক অপূর্ব আসমানী শক্তির তেজোদীপ্ত আলোক ধারায় উদ্ভাসিত হন। এরই মাধ্যমে তঁাঁকে পার্থিব পরিবেশ থেকে মাধ্যাকর্ষণ স্তর ভেদ করে উর্ধ থেকে উর্ধালোকে, এমনকি সৃষ্টি জগতের শেষ সীমা পাড়ি দিয়ে আরও উর্ধে গমনের উপযোগী করে নেয়া হয়। তাঁকে আসমানী পোশাক পরিধান করানো হয়। অতঃপর তাঁকে বুরাকে চড়িয়ে এক নিমিষে জেরুজালেমে নিয়ে আসা হয়। এখানে বায়তুল মুকাদ্দিসে সকল নবী-রসূলের বিশাল জাম’আতে প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) ইমামতি করেন। তিনি যেসব নবীর ইমাম এবং রসূলগণের নেতা অর্থাৎ ইমামুন নাবীয়ীন এবং সাইয়েদুল মুরসালিন তা এখানে প্রমাণিত ও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনিই যে প্রথম নবী এবং সর্বশেষ নবী তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর তাঁর উর্ধালোক সফর শুরু হয়। সঙ্গে ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আ.)। মুহূর্তের মধ্যে প্রথম আসমানের প্রবেশদ্বারে উপনীত হলে আসমানের দ্বাররক্ষী ফেরেশ্তা তাঁদের পরিচয় জানতে চায়। হযরত জিবরাঈল (আ.) পরিচয় প্রদান করেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। ফেরেশ্তারা তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানান। এখানে তাঁর সাক্ষাত পরিচয় হয় হযরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে, দ্বিতীয় আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ঈসা ও ইয়াহ ইয়া (আ.)-এর সঙ্গে। তৃতীয় আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে, চতুর্থ আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ইদ্রিস (আ.)-এর সঙ্গে, পঞ্চম আসমানে হযরত হারুণ (আ)-এর সঙ্গে, ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আ.)-এর সঙ্গে, সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সঙ্গে। সব নবী-রসূলের সঙ্গে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হয়। সপ্তম আসমানে ফেরেশ্তাদের কা’বা বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশ্তার তওয়াফ করতে ও সালাত আদায় করতে দেখেন। এখানে যে ফেরেশতা একবার সালাত আদায় করেন তার দ্বিতীয়বার সালাত আদায়ের সুযোগ ঘটে না। এই বায়তুল মামুরের ঠিক নিচ বরাবর পৃথিবীতে কা’বা শরীফ অবস্থিত। এখান থেকে তিনি সিদরাতুল মুন্তাহার নিকট উন্নীত হন। সিদরাতুল মুন্তাহা বা সীমান্তকূল বৃক্ষের নিকট এসে হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, এটাই আমার শেষ সীমানা; এই সীমানা অতিক্রম করলে আমি পুড়ে ছারখার হয়ে যাব। এখন শুধু আপনি আর আপনার রব্। সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে তিনি রফ্রফ্ েচড়ে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পাড়ি দিয়ে স্থান-কালের উর্ধে লামাকান ও লাযামানে উপনীত হন। তিনি নিকট থেকে নিকটতর হলেন। নূর আর নূরের আতিশয্যে তিনি একাকার হয়ে গেলেন। আল্লাহ্র দিদার লাভ করলেন। বিস্ময় ও আনন্দে নৈকট্য ও পরিপূর্ণতার অপূর্ব অনুভবে অভিভূত হয়ে গেলেন। আল্লাহ্র যা ওহী করার ছিল তা করলেন। কালামে মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। তিনি তো তাঁর রব্রে মহান নিদর্শনসমূহ দেখলেন (সূরা নজম : আয়াত ১৭-১৮)। মিরাজ শরীফের মাধ্যমে প্রিয়নবী হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) জানা-অজানা, প্রকাশ্য ও গোপন তাবত জ্ঞানের নিদর্শন সরেজমিনে অবলোকন করেন এবং আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর কুদরতের সীমা-পরিসীমা প্রত্যক্ষ করে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ মাকামে উন্নীত হন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু উম্মতে মুহম্মদীকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দেন। এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মরতবাও নির্ধারণ করে দেন দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের সমান। বলা হয়েছে : আস্সালাতু মিরাজুল মুমিনীন- সালাত (নামাজ) হচ্ছে মুমিনের জন্য মিরাজ। আমরা সালাতে বসা অবস্থায় যে আত্তাহিয়াতু পাঠ করি সেটা মিরাজকালে আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীবের মধ্যে কথোপকথনেরই বাক্যসমূহ। এখানে উল্লেখ্য, প্রিয়নবী (সা.)-এর মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায়। আল্লাহ্ এই মহাসফরের মাধ্যমে তাঁর হাবীব রাসুলুল্লাহ্ (সা.)কে যেমন সর্বজ্ঞানের অধিকারী করেন, তেমনি তিনি যে সরওয়ারে কায়েনাত বিশ্ব জগতের নেতা তা সর্বত্র জাহির করে দেন। আল্লাহ্ হচ্ছেন রাব্বুল আলামীন আর তাঁর হাবীব হচ্ছেন রহমাতুল্লিল আলামীন- এটা সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পবিত্র মিরাজের রাত রাব্বুল আলামীনের সঙ্গে রহমাতুল্লিল আলামীনের দিদার লাভের রাত, এ এক মহামিলনের রাত। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
×