ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এমএ ইউসুফ খান

নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণ

বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উন্নয়নশীল, জনবহুল ও কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত। মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ পল্লী এলাকায় বসবাস করে এবং কৃষিকাজ করে জীবন ধারণ করে। এ দেশের সমাজ ব্যবস্থা মূলত, গ্রামকেন্দ্রিক। জীবন ধারণের জন্য মৌলিক প্রয়োজনসমূহ থেকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনও বঞ্চিত। অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো অতি প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের সুযোগ এ দেশের জনগণের সামর্থ্যরে বাইরে। বেকারত্ব, কুসংস্কার, নিরক্ষরতা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতা এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিশেষ করে পল্লী এলাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারী প্রচেষ্টার সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে স্বেচ্ছাসেবী এনজিওগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ তথা দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এনজিওগুলো বহুমুখী কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় তাদের সেবাধর্মী কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচী তাদের টার্গেটভুক্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন ধারার সঙ্গে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। সর্বোপরি পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ এ্যাপ্রোচ এনজিওগুলোর জন্য একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এনজিওগুলো শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়েই কাজ করছে না, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নিয়েও কাজ করছে। টার্গেটভুক্ত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই হচ্ছে গ্রামীণ দরিদ্র নারী। তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের সুসংগঠিত করে দল গঠনের মাধ্যমে জীবনমুখী খাতে জামানতবিহীন পরিশোধযোগ্য স্বল্প পরিমাণ অর্থ প্রদান করে তাদের আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে। আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীদের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে তারা সন্তান লালন-পালনসহ গৃহকর্মের যে সকল কাজ করে থাকে তা উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃত নয়। যৌতুক, তালাক, নারী পাচার, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি ঘটনাসমূহ নারীদের নিরাপত্তাহীনতার উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ উপলব্ধি থেকেই এনজিওগুলো দুই দশক ধরে পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র নারী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তথা নারী-পুরুষের অসমতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে যেন নারীর মৌলিক অধিকার ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বিষয়টির নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হয়- এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এনজিওগুলো তাদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ বহু পথ অতিক্রম করে এ পর্যায়ে এসেছে। বর্তমান সময়ে ক্ষুদ্রঋণ একটি বহুল আলোচিত বিষয় যা আজ পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন কাঠামোতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও এ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশের জনসাধারণের মধ্যে ত্রাণ, ওষুধ ও আশ্রয়জনিত পুনর্বাসন কাজে বেশকিছু সংখ্যক দেশী-বিদেশী এনজিও নিয়োজিত হয়। ক্রমান্বয়ে এ সকল এনজিও সেবামূলক ত্রাণ কার্যক্রম থেকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করে এবং পর্যায়ক্রমে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে থাকে। বাংলাদেশের বড় এনজিওগুলো এ সময় সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হতে থাকে। আশির দশকে এসে এনজিওর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এ পর্যন্ত ৭১০টি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাকে সনদ প্রদান করেছে। শীর্ষ ১০-এ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেÑ ব্র্যাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্যুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস, সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিসেস (এসএসএস), জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, উদ্দীপন, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র এবং এসডিএফ ডব্লিউ তাদের বহুমুখী ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচীর মাধ্যমে সারাদেশে ব্যাপকভাবে কর্মপরিধি সম্প্রসারণ করে চলেছে। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের দিক থেকে ব্র্যাক শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। উল্লেখ্য, ব্র্যাক শুধু বাংলাদেশেই নয় সমগ্র বিশ্বের এক নম্বর বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৫ সালে তাদের বিতরণকৃত ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আশা। ২০১৫ সালে তাদের বিতরণকৃত ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। গ্রামীণ ব্যাংকের অবস্থান তৃতীয়। ২০১৫ সালে তাদের বিতরণকৃত ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এভাবে পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট ১০টি শীর্ষ বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ২০১৫ সালে মোট ৮২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে। বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে এ সকল বেসরকারী পর্যায়ের এনজিওগুলোর জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুকÑ এটাই আমাদের একান্ত কাম্য।
×