ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গভীর নলকূপেও মিলছে না পানি

বরেন্দ্রে বাড়ছে পতিত জমি

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

বরেন্দ্রে বাড়ছে পতিত জমি

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ বরেন্দ্র অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে অনাবাদী জমির পরিমাণ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ সংকটের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে হস্তচালিত ও গভীর নলকূপ। ফলে সেচ সংকটের জন্য একদিকে যেমন অনাবাদি থাকছে ফসলি জমি অন্যদিকে খাবার পানির সংকটও তীব্র হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীঘ্রই টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হলে বরেন্দ্র অঞ্চল বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে। তবে সমস্যা সমাধানে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। এর মধ্যে রাজশাহী ও নওগাঁর ১২টি উপজেলা অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় হার্ড বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত। এগুলোর মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর ও পবা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও নাচোল এবং নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, সান্তাহার, পতœীতলা ও ধামুইরহাট। এসব অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে গেছে। এ কারণে বন্ধ হয়ে গেছে হাজারো হস্তচালিত নলকূপ। গভীর নলকূপ বসিয়েও পানি মিলছে না। ফলে চাষাবাদের জন্য তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু সেচ সংকটের কারণে হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত পড়ে আছে এসব এলাকায়। কিছু কিছু এলাকায় কোনমতে চাষাবাদ করছেন কৃষক। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, অধিক ফলনের আশায় ১৯৮৫ সালে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার শুরু করে। বর্তমানে বরেন্দ্র এলাকায় বিএমডিএ’র প্রায় ১৫ হাজারের বেশি গভীর নলকূপ চালু রয়েছে। তবে পানির রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকার নীতিগতভাবে কৃষি কাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর থেকে বিএমডিএ নতুন করে আর নলকূপ বসাচ্ছে না। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানায় গভীর নলকূপ এখনও বসানো হচ্ছে। তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নের কৃষক আজিজুল ইসলাম ও রকিবুল হক জানান, এ এলাকায় এখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে। ফলে হস্তচালিত সব নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। আর ক্রমেই অকেজো হয়ে যাচ্ছে গভীর নলকূপও। পানির অভাবে হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত পড়ে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। এছাড়া পানীয় জলেরও তীব্র সংকট বাড়ছে প্রতিবছর। তানোরের মু-ুমালা পৌর মেয়র গোলাম রব্বানী বলেন, এ এলাকার প্রধান সমস্যা এখন সেচ ও খাবার পানি। একের পর এক গভীর নলকূপ বসিয়েও পানি সংকট সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী, ১৯৮০ সালে উঁচু বরেন্দ্র এলাকাগুলোয় মাত্র ৩৯ ফুট মাটির গভীরে পানি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন এ গভীরতা গড়ে নেমেছে ১৫০ ফুটে। কোথাও কোথাও ১৫০ ফুটের নিচেও মিলছে না পানি। অধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার, স্বল্প বৃষ্টিপাত, পানি পুনর্ভরণ সক্ষমতা কমে যাওয়া ও নদী খাল বিলে পানি না থাকায় মূলত পানির স্তর নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম জানান, ১৯৮০ সালে এ অঞ্চলে পানির স্তর মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। তবে ৩৬ বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটা পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে। এ পানি হস্তচালিত বা গভীর নলকূপে উঠছে না। তিনি আরও জানান, দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এ এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থার সুফল আমরা পেয়েছি। কিন্তু এর অধিক ব্যবহার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে খুব আশঙ্কাজনক ও ভয়াবহভাবে নিচে নামিয়েছে। এভাবে পানির স্তর নিচে নামতে থাকলে পানির আধার কয়েক বছরের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। অনেক এলাকা পানিশূন্য হয়ে পড়বে।
×