ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

শ্রদ্ধা ভালবাসায় লাকী আখন্দকে চির বিদায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

শ্রদ্ধা ভালবাসায় লাকী আখন্দকে চির বিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জীবনটাকে বেঁধেছিলেন সঙ্গীতের সাতটি স্বরে। সুরের সহজাত অনুরাগে জায়গা করে নিয়েছিলেন শ্রোতার অন্তরে। শুক্রবার সেই সুরের বাঁধনটি আলগা করে পাড়ি জমালেন অদেখার ভুবনে। শনিবার অনুরাগীদের ভালবাসায় বিদায় নিলেন প্রিয় এই পৃথিবী ছেড়ে। রেখে গেলেন আপন সৃষ্টি আর সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভক্ত-অনুরাগী, শুভাকাক্সক্ষী ও সহযোদ্ধাদের উজাড় করা ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কিংবদন্তি সুরকার-গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী লাকী আখন্দ। শিল্পীর বাড়ির পাশের আরমানিটোলা মাঠ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দুই দফা জানাজা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং গার্ড অব অনার প্রদান শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আরেক দফা জানাজা শেষে সমাহিত করা হয়। শিল্পীকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, লাকী আখন্দ বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিকর্মের আলোয়। যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে তার সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দিতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ছয়টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লাকী আখন্দ। রাতে তার লাশ রাখা হয় রাজধানী বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে। সেখান থেকে শনিবার সকালে শেষবারের মতো লাকী আখন্দের লাশ নিয়ে আসা হয় তার আরমানিটোলার বাসভবনে। এ সময় পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের অশ্রুজলে শোকাতুর হয়ে ওঠে চারপাশের পরিবেশ। সেখান থেকে তার লাশ নিয়ে আসা হয় আরমানিটোলা মাঠে। পরিবারের সদস্য, এলাকাবাসী, গীতিকার আসিফ ইকবালসহ অনেকেই অংশ নেন প্রথম জানাজায়। আরমানিটোলা থেকে সকাল ১১টায় লাকী আকন্দের লাশ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করা হয়। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেয়া হয় কফিন। গার্ড অব অনার প্রদান শেষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠান। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের পক্ষে লাকী আখন্দের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। লাকী আখন্দকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে হাজির হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আনিসুর রহমান মল্লিক, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, আওয়ামী লীগ নেতা শফী আহমেদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ, শিল্পী সৈয়দ ইকবাল, চারুশিল্পী সংসদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, শিল্পী ফকির আলমগীর, খুরশিদ আলম, তিমির নন্দী, আকরামুল ইসলাম, নকীব খান, কাজী হাবলু, ফুয়াদ নাসের বাবু, গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, গীতিকার কবির বকুল, জলের গানের সাইফুল জার্নাল, লেখক-নাট্যকার শাকুর মজিদ প্রমুখ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর মধ্যে লাকী আখন্দের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাসাস, খেলাঘর, এনটিভি, প্রাচ্যনাট, ঋষিজ প্রভৃতি। আয়োজক সংগঠনের পক্ষে সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব শেষ হয়। এরপর এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিকতা। শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে পরিবারের পক্ষ থেকে মেয়ে মাম্মিন্তি নূর আখন্দ বলেন, আমার বাবা দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন, গান দিয়ে মানুষের মনে আনন্দ দিয়েছেন। তিনি দেশ ও গানকে ভালবাসতেন। তার যদি কোন ভুল-ত্রুটি থাকে তবে ক্ষমা করবেন, সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। হাসানুল হক ইনু বলেন, তিনি যেমন গানের জগতে মানুষের মন জয় করেছিলেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন। তার জন্য যা করার করব। তার সৃষ্টি গানগুলো যেন হারিয়ে না যায় সে জন্য আর্কাইভের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হবে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, লাকী আখন্দ হৃদয় দিয়ে গানকে ধারণ করেছিলেন। যে বয়সে মানুষ গান শেখে সেই বয়সে তিনি অন্যদের গান শিখিয়েছেন। মাঝে কিছুটা সময় ছোট ভাইয়ের মৃত্যু ও নিজের অসুস্থতার কারণে বিপর্যস্ত ছিলেন। তার কাছ থেকে বাংলাদেশ আরও কিছু পেতে পারত। কিন্তু তা আর হলো না। অপূর্ণতা রয়ে গেল। তবে যেটুকু আমরা পেয়েছি, তা অনেক বড় পাওয়া। আনিসুল হক বলেন, বন্ধু লাকী আখন্দ তার সুরে-ছন্দে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তিনি তার গানের মতোই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। এমন শিল্পীকে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া উচিত ছিল, তেমনটি আমরা দিতে পারেনি।’ সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ১৯৭২, ৭৩ ও ৭৪ সালে তিনি বাংলা আধুনিক গানের অসাধারণ সুর করেছিলেন। এ ধরনের ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, লাকী আখন্দ সঙ্গীত জীবনের চমক। আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। বয়স তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। কিন্তু গানের জীবনে কিন্তু তিনি নতুনত্বের স্বাদ পেয়েছেন, দিয়েছেন। যতটা সম্মান পাওয়ার ছিল ততটুকু তিনি পাননি। তাকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করা উচিত। খুরশিদ আলম বলেন, লাকীর মতো শিল্পী চলে গেল, এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার মতো নয়। আর তরুণ গায়কদের বলব, তারা যখন লাকীর গান কোথাও গাইবেন, তখন যেন তার নাম উল্লেখ করেন। নকীব খান বলেন, তিনি আধুনিক বাংলা গানের ভিন্নধারার জন্ম দিয়েছিলেন। তার গান প্রথম শুনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। সে গানে অনুপ্রাণিত হই- কী গানে কী দেশপ্রেমে! সেই গানটি ছিল “জন্মভূমি বাংলা মাগো”। তার মতো আর কেউ চলচ্চিত্র অঙ্গনের বাইরে এত জনপ্রিয় গান আর আমাদের উপহার দিতে পারেননি। তবে আমরা তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আজ লাকী আখন্দকে বাঙালীর শ্রেষ্ঠ স্থান শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানালাম, বিদায় জানালাম। আসলে তাদের কী বিদায় জানানো যায়! যায় না! এই লাল-সবুজ পতাকার মতোই তিনি বেঁচে থাকবেন। শহীদ মিনার থেকে লাকী আখন্দের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তৃতীয় জানাজা শেষে বিকেল পৌনে তিনটায় তার দাফন সম্পন্ন হয়। আগামীকাল সোমবার বাদ আসর লাকী আখন্দের আরমানিটোলার বাসভবনে তার কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে। পরিবারের পক্ষ থেকে এতে শুভ্যানুধায়ীদের অংশ নেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
×