ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী হামলার আশঙ্কা যে কারণে থেকেই যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

জঙ্গী হামলার আশঙ্কা যে কারণে থেকেই যাচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গীরা আত্মঘাতী হামলা জন্য ঘরে বসেই তৈরি করছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাপক বিধ্বংসী গ্রেনেড, বোমা, সুইসাইডাল ভেস্ট, ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস। নিজস্ব প্রযুক্তিতে ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, কেতলি, বালতি, খেলনা তারা বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করছে। এত শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড-বোমা ও বিস্ফোরক কোথায় পায় জঙ্গীরা? নাশকতার জন্য গড়ে তোলার বিস্ফোরকের এত বিশাল মজুদ ভা-ার গড়ে তোলার উৎসই বা কি? ঝিনাইদহের সদর উপজেলার পোড়াহাটির জঙ্গী আস্তানায় অপারেশন ‘সাউথ প’ (দক্ষিণের থাবা) চালিয়ে ২০ ড্রাম বিস্ফোরক তৈরির তরল পদার্থ, বিপুলসংখ্যক বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি উদ্ধারের পর এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্র জানা গেছে, ঝিনাইদহের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের আগে সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলের আস্তানার ভেতরে এত বিপুল বিস্ফোরক মজুদ করা হয়, যা বিস্ফোরিত হলে পুরো ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারত। আতিয়া মহলের পাঁচতলা ভবনের প্রবেশপথে মাইন এমনভাবে রেখে দেয়া হয় যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢুকতে গেলেই বিস্ফোরণ ঘটবে। সিলেটের মৌলভীবাজারের নাসিরনগরও বড়হাট আস্তানায় তো নারী, শিশু, সন্তানসহ গোটা পরিবারই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের সীতাকু-ের দুটি জঙ্গী আস্তানা ও কুমিল্লার কোটবাড়ির জঙ্গী আস্তানায়ও উদ্ধার হয়েছে বিপুল গ্রেনেড-বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি ও বিস্ফোরকের মজুদ। রাজধানীর আশকোনায় এয়ারপোর্ট ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে ট্রলিব্যাগে বহন করা তিনটি বোমার ঘটনা তদন্তকারীরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, এর কিছু উপাদান দেশেই তৈরি, যেমন স্পিøন্টারগুলো দেশেই তৈরি। আবার কিছু উপাদান বিদেশী যেমন ডেটোনেটর ও সার্কিট। তদন্তে দেখা হচ্ছে, এত শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার রাসায়নিক উপাদান সালফার ও পটাশিয়ামের উৎস কোথায়? সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের সীতাকু-, সিলেটের শিববাড়ী, মৌলভীবাজারের নাসিরাবাদ ও বড়হাট এবং কুমিল্লার জঙ্গী আস্তানাগুলোতে ৫ কেজি থেকে ১৫ কেজি ওজনের বোমা উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এয়ারপোর্ট ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে থেকে উদ্ধার করা ট্রলিব্যাগের তিনটি বোমার মধ্যে একটি বোমা ছিল আনুমানিক ১৫ কেজি। এত শক্তিশালী বোমার ব্যবহার অতীতে বাংলাদেশে ঘটেনি বলে জানান তদন্তকারীরা। বোমাটি নিষ্ক্রিয় করার সময় অন্তত ৫০ গজ দূরত্বের মধ্যে সকল স্থাপনা কেঁপে উঠেছে। এমনকি এর স্পিøন্টার অন্তত ৩০ গজ দূরে ছিটকে পড়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকু-ের ছায়ানীড় নামক বাড়ি থেকে একটি কার্টনে এসিড, লিকুইড কেমিক্যাল ও ১২ সেট পাওয়ার জেল, ছোট ছোট পাইপের টুকরা, সুইচ, স্পিøন্টার ও ব্লাস্টিংস ক্যাপ পাওয়া গেছে। এসব সরঞ্জাম ও রাসায়নিক দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ শক্তিশালী বোমা বানানো যেত। মীরসরাইয়ের আস্তানা থেকে ২৯ অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, ৪০ পাওয়ার জেল, ২৮০ প্যাকেট কার্বন স্টিলবল ও ১১ কেজি বিস্ফোরক সদৃশ পাউডার পাওয়া যায়। তদন্ত সূত্র মতে, বিদেশ থেকে বিস্ফোরক আমদানি করার মতো উৎসও ব্যবহার করছে জঙ্গীরা। একইভাবে কিছু বিস্ফোরক পাওয়া যাচ্ছে স্থানীয় বাজারে। তবে বিস্ফোরকের ৮০ ভাগই আসছে সীমান্ত দিয়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শেরপুর সীমান্ত দিয়ে আসছে বিস্ফোরক। ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বিহার থেকে সীমান্ত দিয়ে আসছে বিস্ফোরক। এ ছাড়াও মিজোরাম থেকে শেরপুর হয়ে বিস্ফোরক আনা হচ্ছে। প্রায়ই বিস্ফোরকদ্রব্য জব্দ করা হচ্ছে। গত ১৭ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় অস্ত্র-গুলি ও বিস্ফোরকসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ। তার আগে গত বছরে রাজধানীর দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনার জঙ্গী আস্তানা থেকে দুটি পিস্তল, ১৭টি তাজা গ্রেনেড, সুইসাইড ভেস্টসহ বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। গত বছরের নবেম্বরে গাবতলী থেকে ৭৮৭ ডেটোনেটরসহ নিউ জেএমবির চার সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশের জঙ্গী দমন বিভাগ। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী আবু তাহের, মিজানুর রহমান, সেলিম মিয়া ও তৌফিকুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের জানিয়েছিল, বড় মিজান ও ছোট মিজানের নির্দেশে তারা চাঁপাই সীমান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক ডেটোনেটর নিয়ে আসে। এসব ডেটোনেটর দিয়েই ঢাকায় জঙ্গীরা ঢাকায় নিজের গ্রেনেড তৈরি করে। সীমান্ত ছাড়াও স্থানীয় মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে কেমিক্যাল। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা অবাধে ব্যবসা শুরু করায় যার তার হাতে চলে যাচ্ছে বিস্ফোরক। মাঝে-মধ্যে এ বিষয়ে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপরও বিস্ফোরকদ্রব্যের অবাধ বেচাকেনা বন্ধ হয়নি। বিস্ফোরক আইন থাকলেও তা মানা হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই। ঢাকা ও বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে বোমা, গ্রেনেড, ককটেল। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে কেমিক্যাল উপকরণ যা দিয়ে বিধ্বংসী গ্রেনেড-বোমা, ককটেল তৈরি করে নাশকতা চালাচ্ছে জঙ্গীগোষ্ঠী। গ্রেনেড-বোমা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সালফার, এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পটাশিয়াম, গানপাউডার, পাওয়ার জেল ও ব্ল্যাক পাউডার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও উত্তর দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ পন্থায় সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরক দেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার সীমান্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বৈধ বিস্ফোরক বিক্রির দোকান রয়েছে ৫৯। এসব দোকান বংশাল, টিকাটুলী, সুরিটোলা, করাতিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, মিটফোর্ডসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। এসব বাজার থেকে এবং বিভিন্ন ল্যাব থেকেও জঙ্গীরা বিস্ফোরক দ্রব্য সংগদ্রহ করে। গ্রেনেড-বোমা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সালফার ডাইঅক্সাইড, ফসফরাস, এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ডিডিটি, টিএনপি, লেড অক্সাইড, লেড এ্যাজাইড, মারকারি, গন্ধক ও পটাশিয়াম সালফাইড। চট্টগ্রাম থেকে বাসযোগে যাত্রীবেশে ঢাকায় আসার পথে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী ইমতিয়াজ অমি ওরফে আজওয়াদ ও মাহমুদ হাসান পুলিশকে জানায়, চট্টগ্রামের কয়েকটি আস্তানা থেকে বোমা ঢাকায় সরবরাহ করা হয়েছে। এরপর চট্টগ্রামের সীতাকু-ে চালানো অভিযানের সময় শক্তিশালী বোমা ও সুইসাইডাল ভেস্ট ব্যবহার করে আত্মঘাতী হয় জঙ্গীরা। সেখানে বেশ কিছু বোমা ও বোমা তৈরির উপকরণ জব্দ করা হয়। চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি বানৌজা ঈশা খাঁর ভেতরে বানৌজা পতেঙ্গা মসজিদে বিস্ফোরণের পর আটক আবদুল মান্নানের কাছ থেকেও বোমাসহ একই ধরনের ভেস্ট উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাবের ব্যারাকে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে এবং খিলগাঁওয়ে চেকপোস্টে র‌্যাবের গুলিতে নিহত দুজনের শরীরে সুইসাইডাল ভেস্ট ছিল। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীবিরোধী অভিযানে তৎপরতা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও জঙ্গীদের অস্ত্র ও বিস্ফোরকের সরবরাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জানার আগেই জঙ্গীদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে গ্রেনেড-বোমা, বিস্ফোরক ও অস্ত্র। নব্য জেএমবির সিøপার সেলে প্রশিক্ষিত বোমার কারিগরও রয়েছে। বিস্ফোরকের উৎস বন্ধ করতে না পারায় জঙ্গীদের আত্মঘাতী কর্মকা- প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ফলে নতুন কৌশলে বড় হামলার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এ কারণে জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনার সঙ্গে জঙ্গীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি তাদের অস্ত্র-বিস্ফোরকের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে হবে।
×