ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জমবে মেলা ॥ বটতলা-হাটখোলা

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২২ এপ্রিল ২০১৭

জমবে মেলা ॥ বটতলা-হাটখোলা

আবার জমবে মেলা হাটখোলা-বটতলা। বাঙালী মনের সহজাত ও চিরন্তন এ উচ্চারণ বাংলাকে শুধু সমৃদ্ধই করে না, লালন করে বুকের গভীরে। এ কারণে প্রতি বছর বাংলা বর্ষ নানা বর্ণ-বৈচিত্র্যে পালিত হয় প্রতিটি বাঙালীর ঘরে। বৈশাখ মানে চির নতুন আর অনন্তকালের আবাহন। পুরনো সবকিছু বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেয়ার প্রত্যয়ে বৈশাখের জয়ধ্বনিতে উচ্চারিত হয় ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ বৈশাখী মেলা বাঙালিয়ানার হাজার বছরের লালিত ইতিহাস। আবহমান বাংলা ও বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য। লোক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বৈশাখী মেলা বাঙালীর প্রাণের মেলা হয়ে ফিরে আসে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। বাংলা নববর্ষের প্রথম সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। যা ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-গঞ্জের হাটে-মাঠে-ঘাটে। বৈশাখে হাটখোলা-বটতলার মেলা বাংলা ও বাঙালীর সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য। বাংলা নববর্ষে শহরে ও গ্রামাঞ্চলে যত বৈশাখী মেলা বসে তার অধিকাংশ বটতলা কেন্দ্রিক। বটতলার মেলায় আনন্দ-বিনোদনের কোন কমতি থাকে না। ঐতিহ্যগত আবেদন খুঁজে পাওয়া যায় এসব মেলায়। প্রাণের আবেদন ও বাঙালিপনার ছোঁয়া পাওয়া যায়। আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য বৈশাখী মেলা বসে বটতলা, নিমতলা, হাজরাতলা, পাকুড়তলা, বকুলতলা, শেওড়াতলা। এক শ্রেণীর দোকানি বাঁশ-খুঁটি পুঁতে তাঁবু বা পলিথিন টাঙ্গিয়ে মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি, রং বে-রঙের খেলনা সাজিয়ে ছোট-ছোট শিশু ছেলেমেয়েদের আকৃষ্ট করে। বাঁশি আর ঝুনঝুনি বাজিয়ে মানুষকে মেলায় আসার আহ্বান জানানো হয়। এভাবেই ভিড় বাড়তে থাকে এবং শুরু হয় লোক সমাগম। মানুষের কলরবে এবং নানা ধরণের বাঁশি, ভেঁপু আর ঝুনঝুনির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় ঘুরতে আসা সকল শ্রেণীর মানুষ নানা পণ্য কেনা-কাটা করে। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমাগম ঘটে বটতলার মেলায়। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় খাঁটি বাঙালী প্রাণের স্পন্দন। মূলত চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু করে বাংলা নববর্ষে বৈশাখ মাসব্যাপী পূজা-পার্বণের আয়োজন করা হয়। সকল অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে আয়োজিত নানা দেব-দেবীর পূজা উপলক্ষে মেলা বসে। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় অনুষ্ঠিত মেলায় ধর্ম বর্ণের কোন ভেদাভেদ থাকে না। সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ মেলায় অংশগ্রহণ করে। তবে আগের তুলনায় বটতলার মেলার আবেদন অনেকটা কমে এসেছে। কারণ ধর্মীয় গোড়ামি ও ধর্মীয় অন্ধত্ব মানুষকে পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ বর্তমান প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সব ধরণের মেলাকে দেখা হচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ফতোয়া দিয়ে সমাজে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন এক শ্রেণীর মানুষ মেলাকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে চায়। কিন্তু বাঙালীর প্রাণের উৎসব মেলার আয়োজন থেমে থাকেনি। কেউ কেউ মেলাকে ‘হিন্দুয়ানি’ অনুষ্ঠান বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু তাদের এ যুক্তি মানতে নারাজ সমাজ বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া মেলা ‘হিন্দুয়ানি’ অনুষ্ঠান, এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ বাঙালীর উৎসব সর্বজনীন। মাদারীপুর শহরে জাঁকজমক বৈশাখী মেলাসহ সকল ধরণের মেলা বসে লেকেরপাড় শকুনী বটতলায়। পৌর এলাকার মধ্যে শকুনী বটতলার মেলা এ অঞ্চলের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী। শহরের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র এটি। গাছতলার মেলার ঐতিহ্য রয়েছে। কোন কোন বটতলা মেলার ইতিহাস ২শ’ বছব থেকে ৫শ’ বছরের। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের চৌরাশী গ্রামে সিদ্ধেশ্বরী বটতলায় মেলা বসে। এ মেলা কবে কে প্রতিষ্ঠা করেছে তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে প্রাচীন ও বয়ঃবৃদ্ধদের মতে এর ইতিহাস ৫শ’ বছরের। কোন সিদ্ধ পুরুষ এ মেলার প্রচলন করেছেন বলে স্থানীয়দের ধারণা। পহেলা বৈশাখ সকালে পুজা-পার্বণ চলাকালীন থেকে সিদ্ধেশ্বরী বটতলায় মেলা শুরু হয়। রাত পর্যন্ত চলা এ মেলায় বাংলা ও বাঙালী প্রাণের ষ্পর্শ খুঁজে পাওয়া যায়। ফিরে পাওয়া যায় খাঁটি বাঙালী প্রাণের স্পন্দন। নববর্ষ উদযাপন, আনন্দ বিনোদন আর নানা পণ্য কেনাকাটা করতে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটে চৌরাশী সিদ্ধেশ্বরী বটতলার মেলায়। একই ধরণের মেলা বসে চৌরাশী গ্রামের পশ্চিমপাড়া বাধালিয়াবাড়ি বটতলায়। বাধালিয়াবাড়ি বটতলার মেলা নামে পরিচিত এই মেলার ইতিহাসও ৫শ’ বছরের। প্রতি বছর ৪ বৈশাখ এ মেলা বসে। এ মেলায় পাওয়া যায় স্থানীয় কৃষিজাত পণ্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মৃৎশিল্প, হস্তশিল্পজাত সামগ্রী, শিশুদের মন ভোলানো মাটির খেলনা, নানা ধরণের পোশাক, মেয়েদের পোশাক। লোকজখাদ্য- যেমন চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, খাগড়া, লালী বাতাসা, চিনির তৈরি হাতি, ঘোড়াসহ নানা ধরনের মিষ্টি সামগ্রী বটতলার মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া চৌরশী কাকৈরথোপা গ্রামে কৃষ্ণ মন্দির ও দুর্গা মন্দিরের সামনে বিশাল বটগাছ তলায় মেলা বসে। এখানে মেলা হয় একদিনের জন্য। পহেলা বৈশাখ পূজার পরদিন ২ বৈশাখ বটতলায় মেলা বসে। একই ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামে কালীবাড়ি বটতলায় বসে বৈশাখী মেলা। ৬ বৈশাখ মেলা বসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। কালী মন্দির ও কৃষ্ণ মন্দিরের আঙ্গিনায় প্রতি বছর মেলার আয়োজন করে স্থানীয় ভক্তরা। একই উপজেলার খালিয়া বটতলার মেলা বসে বটগাছকে কেন্দ্র করে টেকেরহাট-কদমবাড়ি সড়কের ওপর। বৈশাখের যে কোনদিন মেলার আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে চৌরাশী গ্রামের সুশীল ঠাকুরবাড়ি বটতলা ও লাউসার বটতলা মেলার আবেদন ছিল মানুষের মুখে মুখে। রাজৈর কালীবাড়ির বটতলার মেলা উল্লেখ করার মতো। প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো কালীবাড়ি বটতলার মেলার বিস্তৃতি ঘটে আশপাশের মাঠ ও পুকুরপাড় পর্যন্ত। অন্যদিকে রাজৈর উপজেলার হরিদাসদি গ্রামে কালীবাড়ি বটতলা ও পান্তাপাড়া বটতলা মেলা বসে ১ থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত। এক সময় রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বটতলা, নিমতলা, হাজরাতলা, পাকুড়তলা, বকুলতলা, শেওড়াতলায় বৈশাখী মেলাসহ নানা ধরণের মেলা বসত। এখন গাছতলা কেন্দ্রিক মেলার সংখ্যা কমে গেছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও পারিপার্শিক কারণে। তবে বটতলার মেলা এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। সদর উপজেলার পেয়ারপুর (কুমড়াখালী) ভীমবাড়ি বটতলার মেলা, পাঠককান্দি কালীবাড়ি বটতলার মেলা ছিল সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ। আরও একটি মেলার সুনাম ছিল সর্বত্র। তা হলো সদর উপজেলার সিদ্ধিরখোলা মিত্রবাড়ির (শ্রীলেখা মিত্র, বর্তমানে ভারতীয় ছবির নায়িকা) বটতলার মেলা ও পেয়ারপুর নগেন চৌকিদার বাড়ি বটতলার মেলা। বর্তমানে এসব বটতলার মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কোন কোনটার অস্তিত্ব টিকে আছে ঐতিহ্যগত কারণে। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×