গত ৭ দিনের করোনা পরিস্থিতি
জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনা। মাসের শুরুতে অর্থাৎ ১ জুন যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ জন সেখানে মাস শেষে ২৯ জুন শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৮৩ জনে। পরীক্ষার বিপরীতে ০.৬৩ শতাংশ হার মাস শেষে পৌঁছাল ১৫.২৩ শতাংশে। মাসের এক তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। আর পুরো মাসে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ২৭৮ জন। এ অবস্থায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে সংশ্লিষ্টদের কপালে। এখনি সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এমন অবস্থায় আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে করোনা চিকিৎসায় আবারও হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলো পর্যালোচনায় জানা যায়, জুনের প্রথম দিন দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ জন। এ দিন শনাক্তের হার ছিল ০.৬৩ শতাংশ। প্রায় একই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ২, ৩, ৪, ৫, ৬ জুন পর্যন্ত। পর্যায়ক্রমে এই দিনগুলোতে শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২২, ২৯, ৩১, ৩৪ ও ৪৩ জন। শনাক্তের হারও থাকে ১ শতাংশের নিচেই। কিন্তু ৭ জুন শনাক্তের সংখ্যা ছাড়ায় ৫০ এর ঘর। এদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে শনাক্ত হয় ৫৪ জন। শনাক্তের হার বাড়ে ১.১৪ শতাংশে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ৮, ৯, ১০, ১১ জুন পর্যন্ত। এই দিনগুলোতে শনাক্তের সংখ্যা ১ জনের নিচে থাকলেও ১২ জুন শনাক্ত হন ১০৯ জন। শনাক্তের হার ছাড়ায় ২ শতাংশ। এরপর উর্ধমুখী গতিতেই বাড়তে থাকে করোনার সংক্রমণ। ১৩ জুন এক লাফে শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৮ জনে। ১৪ জুন নতুন করে শনাক্ত হয় ১৬২ জন। শনাক্ত হার লাফিয়ে বাড়ে ৩.৫৬ শতাংশে। ১৫ জুনও শনাক্ত হয় ২৩২ জন। এদিন শনাক্তের হার হয় ৩.৮৮ শতাংশ। ৩৫৭ জন শনাক্ত হয় ১৬ জুন। ১৭ জুন শনাক্তের হার ছাড়িয়ে ৬ শতাংশের উপরে। এদিন নতুন করে আক্রান্ত হয় ৪৩৩ জন। শনাক্ত হার দাঁড়ায় ৬.২৭ শতাংশ। কিছুটা কমে ১৮ জুন। এদিন শনাক্ত হয় ৩০৪ জন। তবে ১৯ জুন আবারও বাড়ে শনাক্তের সংখ্যা। এদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয় ৫৯৬ জন। আর শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৩৮ শতাংশে। ২০ জুন শুধু শনাক্তই বাড়েনি বরং ১ জনের মৃত্যুর খবরও জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এদিন নতুন করে ৮৭৩ জনের শনাক্তের পাশাপাশি শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে।
এরপর জ্যামিতিক হারে বাড়তেই থাকে সংক্রমণ। ২১ জুন নতুন করে ৮৭৪ জন শনাক্তের পাশাপাশি মৃত্যু হয় ১ জনের। ২২ জুনও মৃত্যুবরণ করেন ১ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়ায় হাজারের ঘর। এদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হন ১ হাজার ১৩৫ জন। আর শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। একইভাবে ২৩ জুন মৃত্যু হয় ১জনের, নতুন শনাক্ত ১ হাজার ৩১৯ জন। শনাক্তের হার ছাড়ায় ১৪ শতাংশ। এক লাফে শনাক্তের সংখ্যা ১৬শ’ ছাড়ায় ২৪ জুন তারিখে। এদিন নতুন করে শনাক্ত হয় ১ হাজার ৬৮৫ জন। শনাক্তের হার গিয়ে পৌঁছায় ১৫ দশমিক ০৭ শতাংশে। ২৫ তারিখ নতুন করে শনাক্ত হন ১ হাজার ২৮০ জন, মৃত্যু হয় ৩ জনের। ২৬ তারিখও বাড়ে শনাক্তের সংখ্যা। এদিন শনাক্ত হয় ১ হাজার ৬৮০ জন। মৃত্যুবরণ করেন ২ জন। ২ হাজার ১০১ জন আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ১ জনের মৃত্যু হয় ২৭ জুন। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে ২৮ তারিখ। এদিন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়। নতুন শনাক্ত হয় ২ হাজার ৮৭ জন। শনাক্তের হার বেড়ে পৌঁছায় ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যা ২৯ জুন অর্থাৎ বুধবারও অব্যাহত থাকে। এদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে কারও মৃত্যু না হলেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে ২ হাজার ২৪১ জন। আর শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশে। ৪ জনের মৃত্যু হয় ৩০ জুন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার। এদিন নতুন করে আরও শনাক্ত হন ২ হাজার ১৮৩ জন। আর শনাক্তের হার গিয়ে পৌঁছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশে। এতে করে শুধু জুন মাসে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ২৭৮ জন। আর এর আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের।
যখন উর্ধমুখী এ শনাক্তের হার তখন এ নিয়ে চিন্তার কথা জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কিছুটা চিন্তিত। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছি। হাসপাতালগুলো রোগীদের চিকিৎসায় প্রস্তুত। সংক্রমণ রোধে গত সপ্তাহে আমরা সভা করেছি। সেখানে কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। অফিস, স্কুলে মাস্ক পরে যাবেন। ট্রেনে-বাসে মাস্ক পরতে হবে। গত সপ্তাহে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছি। কেবিনেটসহ বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিয়েছি। জনগণ এই নির্দেশনা পালন করবে বলে প্রত্যাশা করছি। গত দু-তিনদিন ধরে দুতিনজন করে মারা যাচ্ছেন। সবার প্রতি আহ্বান, আপনারা মাস্ক পরুন, টিকা নিন। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের হার গত ১৫ দিন অনেক কম ছিল। এখন অনেক বেশি। এটার লাগাম টেনে ধরতে চাই, তবে আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। জনগণের সচেতনতা ও মাস্ক পরিধান করা জরুরী। সেটি হলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মাস্ক না পরলে শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাস্ক পরিধান করতে নির্দেশনা দিয়েছি। একটি চিঠি মন্ত্রিপরিষদ থেকে দেয়া হয়েছে। আমাদের সুপারিশ থাকে মাস্কটা শাস্তি দিয়ে নয়, আহ্বান করব সবাই মাস্ক পরবে। তবুও ব্যত্যয় ঘটলে সরকার ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না।
তবে প্রয়োজনে আবারও স্বাস্থ্যবিধি মানতে কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে জানিয়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান জনকণ্ঠকে বলেন, একটা পর্যায়ে আমরা দেখছিলাম করোনা কি সুন্দর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। কিন্তু যেই স্বাস্থ্যবিধিতে একটু শিথিলতা দেয়া হলো তখনই আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করল। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধিতে আবারও কড়াকড়ি আরোপ করতেই হবে। অন্যথায় আগের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতেই পারে।
স্বাস্থ্যবিধিতে কড়াকড়ির কথা বললেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলামও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, করোনার এই উর্ধমুখী প্রবণতা রোধে গত ১৪ তারিখে কি কি করণীয় বিষয়ে সব কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আমরা সবাই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সবাই যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে তাহলে বিপদের কারণে হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, আমাদের অনেক চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসা দিতে গিয়ে। যদি এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই নিজে মাস্ক পরতে হবে অন্যকে মাস্ক পরা নিয়ে সচেতন করতে হবে। এর বিকল্প নেই।
এদিকে রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল-গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাসের শুরুতে হাসপাতাল-গুলোতে রোগীর সংখ্যা কম থাকলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে রোগীও। ডিএনসিসির কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে প্রতিদিনই রোগী ভর্তি বাড়ছে জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, জুনের শুরুতে যদিও আমাদের এখানে রোগীর সংখ্যা একেবারেই কম ছিল। কিন্তু মাসের মাঝামাঝি থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখনও বাড়তিই আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের চিকিৎসার পরিধি আরও বাড়াতে হবে। তবে রোগী যদি বাড়ে তাহলে চিকিৎসা দেয়ার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
একই কথা বলেন রাজধানীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টি বি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তার। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় মানুষ আর স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এমনকি মাস্কও ব্যবহার করছে না। আর এতে করেই বাড়ছে করোনা। তবে এতে ভয়ের কোন কারণ নেই। সঠিক নিয়মে মাস্ক ব্যবহার করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চললে পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেই আমি মনে করি।
হাসপাতালে ৫০টি শয্যা করোনা রোগীদের চিকিৎসায় অব্যবহৃত অবস্থায়ই রাখা হয়েছে জানিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ খলিলুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এখন প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে। তাই যদি রোগী বাড়ে শয্যার সংখ্যাও আরও বাড়ানো হবে।
তবে মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না হলে আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, দেখেন গত ছয় মাসে আমরা ভাইরাসটিকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলাম। একটা সময় মনে হচ্ছিল ভাইরাসটি বুঝি পুরোপুরিই চলে যাবে। তখন মানুষের মধ্যেও সচেতনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু যেই সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো সেই থেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও উধাও। মানুষজন এখন মাস্কও ব্যবহার করে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরে থাক। কিন্তু এভাবে যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আরোপ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। আর কিছু না হোক অন্তত মাস্ক ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে। আমাদের টিকাদান কর্মসূচীও চলছে পুরোদমে। ইতোমধ্যে প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজের কার্যক্রম আমরা গুছিয়ে এনেছি। এখন বুস্টার ডোজের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় শুধু মানুষের সচেতনতার অভাবে যদি সংক্রমণ আবারও বাড়ে তাহলে দুঃখের কোন সীমা থাকবে না। তিনি সাধারণ মানুষসহ গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান, করোনার সংক্রমণ এড়াতে নিজেকে যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে তেমনি পাশের মানুষকেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।