ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালী সংস্কৃতিতে বর্ষবরণ

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২২ এপ্রিল ২০১৭

বাঙালী সংস্কৃতিতে বর্ষবরণ

পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে বাংলা নববর্ষের আনুষঙ্গিক বরণানুষ্ঠান। এমন ‘বর্ষবরণ’ বাঙালী সংস্কৃতির মূল নিয়ামক। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেলায় মৃৎশিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সবার দৃষ্টি কাড়ে। শিশুদের জন্য বাঁশি, পুতুল, খেলার অন্যান্য সামগ্রী ও মনোহরী ইত্যাদি দ্রব্যসামগী মেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হচ্ছে অন্যতম। বিগত ১৯৯২ সাল থেকে চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই ‘মঙ্গল’ শোভাযাত্রার শুরু। প্রতিবছর বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বাঘ, হরিণ, হাতি, মোরগ ইত্যাদির প্রতিকৃত তৈরি করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রদর্শন করে থাকে। তাদের শিল্পবোধ ফুটে ওঠে অত্যন্ত সুন্দর ও অর্থবহভাবে। যা মানবিক ঐক্যের জায়গাকে প্রসারিত করতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার অঙ্গীকার হচ্ছেÑ অন্ধকারকে পেছনে ফেলে আলোর দিকে যাত্রা করা। বাংলা বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে এই ‘মেলা’ এবং ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ইত্যাদি হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের একটি অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক জায়গা। এসময় ‘প্রকৃতি’ও তার আপন রূপটাকে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে তুলে ধরে। এক্ষেত্রে ‘প্রকৃতি’ বিশেষ কোন মহল বা কারও প্রতি দয়ার আধিক্য দেখিয়ে অন্যদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। প্রকৃতি তার নিজস্ব স্বভাবেই চলে, অন্য কারও চাপিয়ে দেয়া স্বভাবে চলে না। সেই প্রকৃতির কাছে ফিরে গেলেই তো আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্বজাত্য সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হতে পারি। আমরা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে একাকার হয়ে উঠতে পারি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দেয়াল ভেঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এই বর্ষবরণ পালন করার মধ্যে নিহিত আছে মানবিক মূল্যবোধের ঠিকানা গড়া এবং জাতিসত্তার শেকড়ের সন্ধান করা। অন্ধকারের অপশক্তিরা বাংলা বর্ষবরণ, তৎকেন্দ্রিক মেলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো অনুষ্ঠানাদি মেনে নেয়নি এবং এখনও মেনে নেয় না। বরং উল্টো প্রতিহত করার হুমকি দিয়ে থাকে। কারণ ওরা ‘সত্য’ ও সুন্দরের পূজারী নয়। কোন কিছু সমর্থন না করার পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ প্রতীকী অর্থে যে কোন অসাম্য-অনিয়ম-অযৌক্তিক ও অমঙ্গলের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়ে থাকে। ‘মঙ্গল’ শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ যারা বুঝতে বা জানতে চায় না, তারা কি করে ‘মানুষ’ হতে পারে? মানবিক চেতনার প্রকৃত মানুষ হতে হলে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও সংস্কৃতিবোধে আগে বাঙালী হতে হবে। যারা এই সংস্কৃতিবোধের বিরুদ্ধাচারণ করে থাকে, তারা কিন্তু এদেশেরই বাঙালী। বাঙালী হয়েও এরা ভিনদেশী অপসংস্কৃতির সেবাদাসে পরিণত। ভিনদেশী সংস্কৃতির সেবাদাসে কোন গৌরব নেই। গৌরব বরং স্বজাত্য সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে ধারণ করার মধ্যেই। অন্যের কাছ থেকে ধার করার চাইতে নিজেরটা অনেক মূল্যবান। জাতিসত্তার বিকাশও ঘটে এখান থেকেই। যারা নিজেদের জাতিগত সংস্কৃতিবোধকে নিজেরাই ঘৃণা করে, তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। যে কারণে তাদেরই কতিপয় জঙ্গী নিজেরাই নিজেদের বোমা বিস্ফোরণে (সুইসাইডেল ভেস্টের মাধ্যমে) আত্মহননের পাশাপাশি তাদের অবুঝ শিশুদেরও হত্যা করছে। এটি কেমন আদর্শ হতে পারে? ওরা কি মানুষ না অন্যকিছু? আমাদের বুঝতে হবেÑ আমরা ‘বাঙালী’। আমাদের ভাষা এক ও অভিন্ন। অভিন্ন-একক ভাষার মানুষদের মধ্যে ভিন্ন সংস্কৃতি হবে কেন? এটি কি স্ববিরোধী নয়? এ রকম কখনও হতে পারে না। স্বজাত্য সংস্কৃতির চর্চা না হলে বা তৎক্ষেত্রে অপর ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রভাব পড়লে সে জাতি বিকাশ তো দূরের কথা, অচিরেই ধ্বংস হওয়ায় আশঙ্কা থাকে। এ জন্য প্রয়োজন বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনায় অভিন্ন অর্থাৎ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। এজন্য জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী। খন্দকার মাহ্বুবুল আলম আনন্দবাজার, চট্টগ্রাম
×