ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নব্য জেএমবির অর্ধশত আত্মঘাতী জঙ্গী পলাতক

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২২ এপ্রিল ২০১৭

নব্য জেএমবির অর্ধশত আত্মঘাতী জঙ্গী পলাতক

শংকর কুমার দে ॥ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জঙ্গীবিরোধী অভিযানের ঘটনায় পালিয়ে যাওয়া নব্য জেএমবি নামের জঙ্গী সংগঠনটির অন্তত ১৯ দুর্ধর্ষ আত্মঘাতী জঙ্গীর নাম পেয়েছে জঙ্গী বিষয়ক তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ‘নব্য জেএমবি’ নামের জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাসার ওরফে চকোলেট! সারাদেশে গত ১০ মাসে নব্য জেএমবির ৫০ আত্মঘাতী জঙ্গী নিহত হয়েছে, যাতে জঙ্গী সংগঠনটির মেরুদ- ভেঙ্গে গেছে। তবে পলাতক যেসব আত্মঘাতী জঙ্গী রয়েছে তার মধ্যে দশ মাস আগে গুলশান জঙ্গী হামলায় জড়িত অন্তত ৬ জঙ্গী ধরা পড়েনি এখনও। নব্য জেএমবির পলাতক আত্মঘাতী জঙ্গীর সংখ্যা অর্ধশত হতে পারে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। পলাতক এসব আত্মঘাতী জঙ্গী এখনও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। জঙ্গী তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্র জানান, সারাদেশে প্রায় ১০ মাস ব্যাপী জঙ্গীবিরোধী অভিযানে যেসব আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে তার মধ্যে প্রায় প্রতিটি আস্তানা থেকে পালিয়ে গেছে এক বা একাধিক আত্মঘাতী জঙ্গী। শুধুমাত্র সর্বশেষ গত ৩১ মার্চ সিলেটের শিববাড়ি ও মৌলভীবাজারে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নিহত ১৪ জনের মধ্যে আত্মঘাতী ৭ জঙ্গীর সবাই নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের শিববাড়িতে যে ৪ জঙ্গী নিহত হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষ জঙ্গী মাইনুল ইসলাম মুসা রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। মুসা নিহত হওয়ার পরই নব্য জেএমবির নেতৃত্বে রয়েছে আজিমপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতার হওয়া নারী জঙ্গী ফেরদৌসী আফরিন ওরফে শারমিনের স্বামী বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট। পলাতক এসব জঙ্গী নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন আস্তানা তৈরি করে বিস্ফোরকের মজুদ গড়ে তুলছে। নতুন সদস্য সংগ্রহ করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নাশকতার কাজে লাগানো হচ্ছে। পলাতক এই ১৯ জঙ্গীকে ধরতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, নব্য জেএমবির পুরনো সদস্যদের মধ্যে সর্বশেষ মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা সংগঠনটির হাল ধরেছিল। তার মাধ্যমেই ১৯ পলাতক জঙ্গী সংগঠনকে শক্তিশালী করার কার্যক্রম চালাচ্ছিল। তাদের তত্ত্বাবধানে আরও কিছু জঙ্গী নতুন করে অস্ত্র ও বোমার প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। নানা তথ্য ও আলামত বিশ্লেষণ করে তারা ধারণা করছেন, সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলের জঙ্গী আস্তানায় কমান্ডো অভিযানে মাইনুল ইসলাম মুসা নিহত হয়েছে। বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। ওই জঙ্গী নিহত হলে পলাতক অন্য ১৯ জঙ্গীর মধ্যেই কেউ একজন হয়ত সংগঠনের হাল ধরার চেষ্টা করবে, যার মধ্যে রয়েছে শীর্ষ জঙ্গী নেতা বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট। পলাতক এসব জঙ্গীকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। সিটিটিসি সূত্র জানায়, মুসার পর নব্য জেএমবির সবচেয়ে সক্রিয় সংগঠকের নাম বাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাসার ওরফে চকোলেট। তার নেতৃত্বে রয়েছে আনাসা ওরফে আনিস, রনি, সাগর, রিপন, সারোয়ার, ইকবাল, শরিফুল ইসলাম খালিদ, মানিক, মামুন, বাদল, জুনায়েদ খান, আজাদুল কবিরাজ, রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, ছোট মিজান ও ডাঃ রোকনুদ্দীন। নব্য জেএমবির নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে বলে তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। জঙ্গীবিরোধী টানা অভিযানের মুখে কয়েক মাস আগে রিপন ও খালিদ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য থাকলেও তারা মাঝে মধ্যেই দেশে আসছে বা জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এমনকি তারা সেখান থেকেই দেশে পলাতক জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সাংগঠনিক কার্যক্রম তদারকি করছে। ডাঃ রোকনের সপরিবারে সিরিয়া চলে যাওয়ার তথ্য থাকলেও দেশে জঙ্গীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকতে পারে বলে তদন্তকারীদের দাবি। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর দুর্ধর্ষ জঙ্গী চকোলেটের নাম বেরিয়ে আসে। ওই শীর্ষ জঙ্গী চকোলেট তার স্ত্রী ফেরদৌসী আফরিন ওরফে শারমিনকে নিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর আজিমপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে গত সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হয় শারমিন। গ্রেফতারের পর স্ত্রীর দেয়া তথ্যানুযায়ী স্বামী চকোলেট জঙ্গী সংগঠনে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। নব্য জেএমবিতে মানিক কমান্ডার মানিক, অপারেশন বাস্তবায়নকারী বাদল ওস্তাদ বাদল নামে পরিচিত। সাগর নব্য জেএমবির এক সময়ের ন্যাশনাল অপারেশন কমান্ডার নিহত মারজানের বোনের স্বামী। আজাদুল কবিরাজ সংগঠনের নতুন সদস্যদের মগজ ধোলাইয়ের কাজ করে থাকে। এ ছাড়া মামুন ও জুনায়েদ খানও সংগঠনে দায়িত্বশীল অবস্থানে। গত বছরের জুলাইয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের পর এসব জঙ্গীর নাম বেরিয়ে আসে। ওই অভিযানের সময় নব্য জেএমবির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ইকবাল পালিয়ে যায়। এ ছাড়া আশকোনা ও আশুলিয়ার অভিযানে বেরিয়ে আসে জঙ্গী ছোট মিজান ও সারোয়ারের নাম। রাশেদ ওরফে র‌্যাশ নামের জঙ্গীর নাম বেরিয়ে আসে অভিযানে নিহত জঙ্গী তানভীর কাদেরীর ছেলে কিশোর জঙ্গী তাহরিম কাদেরীর জবানবন্দীতে। কিশোর জঙ্গী তাহরিম কাদেরীর জবানবন্দীতেও উল্লেখ করা হয়েছে, নিহত গুলশান হামলাকারীদের সঙ্গে বসুন্ধরার বাসায় চকোলেট আঙ্কেলের যাতায়াত ছিল। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, গত ১০ মাসে নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত অন্তত ৫০ জঙ্গী নিহত হয়েছে। নিঃসন্দেহে নব্য জেএমবি নামের জঙ্গী সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। যারা পলাতক আছে তারাই হয়ত নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। যার প্রমাণ মেলে চট্টগ্রামের সীতাকু-, সিলেটের শিববাড়ি ও মৌলভীবাজারের নাসিরনগর ও বড়হাটের জঙ্গী আস্তানায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানের ঘটনায়। এ ছাড়াও রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাবের ব্যারাকে, খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের চেকপোস্টে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা এবং কুমিল্লার জঙ্গী আস্তানার ঘটনায় ধারণা দেয়, নতুন জঙ্গী সদস্যকে মাঠে নামানো হয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় ১০ মাস আগে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৫ জনের জড়িত থাকার কথা জানতে পেরেছে তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। পাঁচ জঙ্গী ঘটনাস্থলেই নিহতসহ বিভিন্ন সময়ে জঙ্গী বিরোধী অভিযানে আরও জঙ্গী নিহত হলেও অন্তত ৬ জঙ্গী এখনও পলাতক। তবে এদের বাইরে আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। গুলশান হামলার পর থেকে সিটিটিসি, পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গী আস্তানায় নিহত হয়েছে নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী, অর্থদাতা সারোয়ার জাহান, তানভীর কাদির, নুরুল ইসলাম মারজান, মেজর (অব) জাহিদ, আবু রায়হান তারেক, আব্দুল্লাহ ও আকাশ নিহত হওয়ার পর এখন শীর্ষ জঙ্গী নেতা হিসেবে পলাতক রয়েছে বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট। এর মধ্যে বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট বাশার গুলশান হামলায় দুবাই থেকে আসা ১৪ লাখ টাকা বাংলাদেশে গ্রহণ করে। অপরদিকে গুলশানে জঙ্গী হামলার আগে নিউ জেএমবির তহবিলে টাকা দেয় ডাক্তার রোকন। সে পরিবারসহ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে সিরিয়ায় যায়। সংগঠনটির শূরা বোর্ডেও এক সদস্য টাকা গ্রহণ করে। দুই দেশ ঘুরে হাত বদল হয়ে এ টাকা বাংলাদেশে পৌঁছে। গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত পলাতক ৬ জঙ্গী হচ্ছে জঙ্গী রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, ছোট মিজান, বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, মাইনুল ইসলাম মুসা ও সিরিয়ায় পলাতক ডাক্তার রোকন। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া জঙ্গী আস্তানা থেকেও দুই থেকে তিন জঙ্গী পালিয়ে গেছে। এ ছাড়া গত মার্চে কুমিল্লার কোটবাড়ীর জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার করা হলেও তখন দুই জঙ্গীকে পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম পুলিশ অভিযান শেষে বলেছেন, পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গীর একজনের নাম আনাস ওরফে আনিস ও অপরজনের নাম রনি। পলাতক আনাস বা আনিসের বাড়ি নোয়াখালী এলাকায়। বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর। সে গত চার-পাঁচ মাস ধরে পরিবার থেকে নিখোঁজ। আরেকজনের সাংগঠনিক নাম রনি। পাঁচ মাস আগে ‘পুরনো জেএমবিতে’ যোগ দিয়েছে। বয়স আনুমানিক ২২-২৩ বছর। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায়। ডিআইজি শফিক অভিযান শেষে বলেন, পলাতক জঙ্গীদের ছবি আমরা পরে আপনাদের সরবরাহ করতে পারব, যাতে মানুষ তাদের আইডেনটিফাই করতে পারে এবং কোথাও দেখলে আমাদের জানাতে পারে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গীরা। এদের মধ্যে ১৭ বিদেশী, তিন বাংলাদেশী ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। ২ জুলাই কমান্ডো অভিযানে ৫ জঙ্গীসহ ছয়জন নিহত হয়। এই ঘটনায় পুলিশ গুলশান থানায় মামলা দায়ের করে। মামলাটি বর্তমানে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) তদন্ত করছে।
×