ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংক্রামক রোগ কমছে, বাড়ছে অসংক্রামক

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২২ এপ্রিল ২০১৭

সংক্রামক রোগ কমছে, বাড়ছে অসংক্রামক

নিখিল মানখিন ॥ দেশে অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত ছয় বছরের পরিসংখ্যানে বেড়েছে ৭ শতাংশ। বর্তমানে অসুস্থ মানুষদের ৬১ শতাংশই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। দেশের ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ৯৭ শতাংশের কমপক্ষে একটি সংক্রামক রোগের ঝুঁকি আছে। আর এই জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের আছে দুটি রোগের ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক অসংক্রামক রোগের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। দেশে পূর্ণাঙ্গ লিভার প্রতিস্থাপন ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৮ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে ১ দশমিক ৩ জন। প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার রোগীর কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এসব রোগ মোকাবেলায় কোন জাতীয় দিকনির্দেশনা নেই। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন ‘হেলথ বুলেটিন ২০১৬’তে বলা হয়েছে, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ন, ধূমপান, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের প্রসার, বায়ুদূষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, মানসিক চাপের কারণে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। প্রতিবেদনে হৃদরোগ, স্নায়বিক রোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, স্থায়ী বক্ষব্যাধি, আর্সেনিকোসিস, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, মুখের রোগ- এগুলোকে অসংক্রামক রোগ বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে পানিতে ডোবা, সাপে কামড়, আত্মহত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা, এসিডে পোড়া রোগীদেরও এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, মানসিক চাপ, ধূমপান, ভেজাল খাবার, বায়ুদূষণের কারণে অসংক্রামক রোগ বাড়ছে। ফাস্ট ফুডে অভ্যস্থ হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণেও এর ঝুঁকি বাড়ছে। তিনি বলেন, ভেজাল, ধূমপান, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেয়া রোগীর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ছে। ২০০৯ সালে জাতীয় এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১ লাখ ৬০ হাজার ৮ জন চিকিৎসা নেয়। ২০১৪ সালে বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৩৩ জনে। একই সময়ের ব্যবধানে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। একইভাবে জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছরই এই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে ক্যান্সারের রোগীও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে, দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। আর অসংক্রামক রোগে আক্রান্তরা খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এ ধরনের রোগের চিকিৎসা ব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে চলে যাচ্ছে। অসংক্রামক রোগ আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। অনেক সংক্রামক রোগের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে কার্ডিওলজিভাস্কুলার ডিজিজ (সিভিডি), ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী সংকোচনজনিত রোগ। বর্তমানে দেশে অসংক্রামক রোগের শতকরা ১৭.৯ ভাগ উচ্চ রক্তচাপ, ৩.৭ ভাগ ক্যান্সারে, এ্যাজমায় ৩ ভাগ, ডায়াবেটিসে ৩.৯ ভাগ ও ২.৪ ভাগ ভুগছে স্ট্রোকে। সংক্রামক রোগকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে নীরব ঘাতক সংক্রামক রোগ উপেক্ষিত রয়ে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আজ সমগ্র জাতির সামনে দৃশ্যমান। অধিকতর কারিগরি নির্ভরশীলতা আমাদের কম কায়িক পরিশ্রম এবং অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবারের দিকে ধাবিত করছে। যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে দেশের শতকরা ৬১ ভাগ রোগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ দীন মোঃ নূরুল হক বলেন, সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে। আর দ্রুত বাড়ছে অংসক্রামক রোগ। অধিক বয়স্ক লোকের সংখ্যা এবং অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, অশিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে। এসব রোগের চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধ করার বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। এদিকে, অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন ব্যবস্থা নেই। লিভার প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রায় ১৮শ’ থেকে ২২শ’ গ্রাম লিভার থাকে। এর দু’-তৃতীয়াংশ অন্যত্র ব্যবহৃত হতে পারে। স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার গড়ে উঠলে এ ব্যয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখে নেমে আসতে পারে। এ কাজ সম্পন্ন করতে সিঙ্গাপুরে আড়াই কোটি টাকা এবং ভারতে লাগে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। দেশের শত শত লিভার রোগীর পক্ষে কোটি টাকা যোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠে না। একই অবস্থা বিরাজ করছে কিডনি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ রেনাল এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেই প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। বিদেশে এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য। প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার রোগীর কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি জানায়, দেশে বর্তমানে ৬০ লাখ ডায়াবেটিক রোগী রয়েছে। আগামী ২০৩০ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম স্থানে। নানা কর্মসূচী অব্যাহত রাখার পরও দেশের ৬০ লাখ ডায়াবেটিক রোগীর মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ রোগীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। ডায়াবেটিক সমিতি নিজে থেকে সারাদেশে ডায়াবেটিক প্রতিরোধ কার্যক্রমে নামলেও জাতীয়ভাবে এ রোগ মোকাবেলায় কোন দিকনির্দেশনা নেই। ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকি জানান, আর বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৮ জন আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে ১ দশমিক ৩ জন। আর প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা না পড়লে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকে না।
×