ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের ৪০ কারখানা থেকে আসছে এ ভয়াবহ মাদক

কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবার স্রোত

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২২ এপ্রিল ২০১৭

কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবার স্রোত

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না মরণনেশা ইয়াবার চোরাচালান। সীমান্তের ওপারে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের প্রায় ৪০ কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার চালান বাংলাদেশে ঢুকছে বানের পানির মতো। কোন চালানে থাকছে হাজার হাজার, আবার কোন চালানে লাখ লাখ। স্থল ও নৌপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি বলবৎ থাকা সত্ত্বেও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই চালানে চালানে এসব মাদক আসছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহাগরীতে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ ২ এবং সীতাকু-ে ৪২ হাজার পিসসহ একটি ট্রাক ও পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব সেভেন। মূলত ইয়াবার চালান আসে মিয়ানমার সীমান্ত গলিয়ে স্থল সীমান্ত পথে টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতে, ইয়াবা পাচার কাজে ২০টিরও বেশি সিন্ডিকেট সক্রিয়। ক্যারিয়ার হিসেবে রোহিঙ্গা নরনারীর বড় একটি অংশ জড়িত। টেকনাফে ইয়াবার মূল গডফাদারদের আস্তানা। টেকনাফে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরদের যে এ্যান্টেনা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বহু এলাকাজুড়ে সচল থাকে। ফলে বাংলাদেশী মোবাইল অপারেটরদের সিম ব্যবহার করে সে দেশের চোরাচালানি সিন্ডিকেট এদেশের চোরাচালানীদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। দেশে পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার সদস্যের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনযোগে সড়কপথে এবং নৌপথে মরণনেশা ইয়াবার বিভিন্ন মূল্যের চালান চলে আসছে। এসব চালান প্রতিনিয়ত যা ধরা পড়ছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আড়ালে-আবডালে চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যায় রাজধানী ঢাকায়। সেখান থেকে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ক্যারিয়ারদের মাধ্যমে পৌঁছে যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতোপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইয়াবা চোরাচালানীদের বিশাল একটি লিস্টও তৈরি করা হয়। এতে গডফাদারদের নাম যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে এ কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অনেকের নাম। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের হাতে যারা ধরা পড়ছে তারা সাধারণ ক্যারিয়ার। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট সদস্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। কক্সবাজারের উখিয়া দরগাবিল, ডিগলিয়া পালং, ভালুকিয়া, আমতলী, ডেইলপাড়া, বালুখালী, ঘুমধুম, তুমব্র, থাইনখালী, রহমতের বিল, টেকনাফের উলুবনিয়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, জাদিমুরা, জালিয়াপাড়া, নাইট্যংপাড়া, শাহপরীরদ্বীপ, শীলবনিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, নাজিরপাড়া ও চৌধুরীপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন ছোট-বড় আকৃতির ইয়াবার চালান দেশে ঢুকছে। ইয়াবার ক্যারিয়াররা সীমান্তরক্ষীদের পাহারা ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত গলিয়ে দেশে প্রবেশের পর প্রথমে সীমান্ত সন্নিহিত বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। এরপর সুবিধা অনুযায়ী ক্যারিয়ারের মাধ্যমে চালান করে দেয়া হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওসব ইয়াবা সড়কপথে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন সিন্ডিকেটের হাতে পৌঁছে দেয়। এছাড়াও পর্যটকবেশী কতিপয় পাচারকারী বিলাসবহুল গাড়িতে করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিনব কায়দায় ইয়াবা নিয়ে যাচ্ছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন অনেকক্ষেত্রে পর্যটক মনে করে ওসব গাড়িতে তল্লাশি শিথিল করে থাকে। শুধু উখিয়ায় ২০টির অধিক ইয়াবা সিন্ডিকেট স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওসব সিন্ডিকেটের মধ্যে উপজেলার হরিণনমারার ফরিদ সিন্ডিকেট, জাদিমুরার হেলাল সিন্ডিকেট, দুছড়ির আতাউল্লা ও মীর আহামদ সিন্ডিকেট, ঘিলাতলীর মুবিন সিন্ডিকেট, ঘুমধুমের ইমাম হোসেন, সাহাবউদ্দিন সিন্ডিকেট, বালুখালী পানবাজারের বকতার, জাহাঙ্গীর, এনাম সিন্ডিকেট, হাজীরপাড়ার মাহমুদুল হক সিন্ডিকেট, উখিয়ার উত্তম সিন্ডিকেট, হিজলিয়ার বাবুল সিন্ডিকেট, কুতুপালং এলাকার মিজান ও আলী আকবর অন্যতম। উল্লেখিত প্রতিটি সিন্ডিকেটে ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো ক্যারিয়ার থাকে। এদের অনেকেই আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মীও রয়েছে। এদিকে এক লাখ ইয়াবাসহ ঢাকায় আটক কক্সবাজার জেলা যবুদলের সহসভাপতি ইয়াবা সিন্ডিকেটের সেকেন্ড ইন কমান্ড নেজামউদ্দীন রিমান্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। ৫ দিনের জিজ্ঞাসাবাদে নেজাম উদ্দিন ইয়াবা সিন্ডিকেটের ১৮ জনের নাম প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি নেজামের সঙ্গে রিমান্ডে থাকা শীপক মল্লিকও টেকনাফ-কক্সবাজার শহর, সদরসহ চট্টগ্রাম এবং ঢাকার সিন্ডিকেট সদস্যদের নাম জানিয়েছে। টেকনাফ সাবরাংয়ের ইয়াবা গডফাদার সিন্ডিকেট প্রধান ইউনুছের প্রধান ইয়াবা সরবরাহকারী কুলালপাড়ার সোহেলকে পুলিশের ধরপাকড় থেকে বাঁচাতে একটি তদ্বিরবাজ মহল ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশয়দাতা প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধি কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টেকনাফ অঞ্চলের ইয়াবা চোরাচালান সিন্ডিকেটের চিহ্নিত সাইফুল করিম প্রকাশ ইয়াবা সাইফুল, সাবরাংয়ের সাবেক যুবদল নেতা ইউনুচ সিকদার, টেকনাফ কুলালপাড়ার সোহেল, শাহীন ও নুরুল আবছার, জালিয়াপাড়ার মোঃ ইসহাক, চট্টগ্রামের সাহেদ, ঢাকার আকতার ও রানাসহ অনেকের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। কিন্তু এরা আইনের আওতার বাইরে থেকে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জোরালো অবস্থানে রয়েছে। অপরদিকে, টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা পাচারে সক্রিয় ২০টির বেশি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত দেশে ঢুকছে ইয়াবার বড় বড় চালান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি সিন্ডিকেটের ইয়াবা লুটপাট নিয়ে তোলপাড় চলছে। গত ৭ মার্চ রাতে শাহপরীরদ্বীপ মাঝেরপাড়ায় ঘটে ইয়াবা লুটপাটের ঘটনা। ওই দিন রাতে মিয়ানমার থেকে ফিশিং ট্রলারে চালান আসে ৬ লাখ পিস ইয়াবার। ট্রলার থেকে খালাস করার এক পর্যায়ে এলাকার অপর একটি সিন্ডিকেট ইয়াবার ওই চালানের এক-তৃতীয়াংশ লুট করে নিয়ে যায়। বিষয়টি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকদফা হানা দেয়। শক্তিশালী এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রক হচ্ছে মৌলভী আরমান। শুধু ইয়াবা নয় মিয়ানমার থেকে স্বর্ণের চোরাচালানের সঙ্গেও তার নাম রয়েছে।
×