ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাহারি নামের হোটেল রেস্তরাঁর শহর এখন ঢাকা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২২ এপ্রিল ২০১৭

বাহারি নামের হোটেল রেস্তরাঁর শহর এখন ঢাকা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মানুষের রুচির সঙ্গে স্বাদ, রং আর গন্ধ নিত্য পরিবর্তনশীল। প্রত্যেকেই চায় একটু ভিন্ন স্বাদ, একটু ভিন্ন ঘ্রাণ। ভোক্তা চান স্বাস্থ্যকর, মুখরোচক খাবার আর প্রতিষ্ঠান চায় সুনাম। তাই রাজধানীতে চোখের পলকে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ফাস্টফুড আর রেস্তরাঁ। নতুন খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে তাই তো এসব রেস্তরাঁয় ঝুঁকছে ভোজনপ্রিয় মানুষ। রাজধানীজুড়ে বাড়ছে কর্মজীবী মানুষের পদচারণা। সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি; এই তিন কারণেই মূলত মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। সঙ্গে বদলে যাচ্ছে খাবারের অভ্যাস। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে তাই এখন অনেকে বাড়ির খাবারের বাইরে রুচি বদলাতে ছোটেন হোটেল-রেস্তরাঁয়। আর ভোক্তার রুচি ও চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে রাজধানীর প্রতিটি রেস্তরাঁ যেন মেতে উঠেছে। বাংলাদেশ হোটেল-রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রায় দশ হাজার হোটেল-রেস্তরাঁ রয়েছে। দেড় কোটি জনসংখ্যার রাজধানীতে প্রায় এক কোটি মানুষই কাজের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে সময় কাটান। আর যেখানেই যান না কেন আশপাশে নিশ্চয়ই চোখে পড়বে কোন না কোন হোটেল-রেস্তরাঁ। তাহলে কেনইবা কেউ বাড়তি সময় নষ্ট করে ঘরের খাবার খাবেন। তাই তো ঢাকার ব্যস্ত নগরবাসী এখন পেটপূজা সারতে পারেন সহজেই। পেটপূজার পাশাপাশি রাজধানীবাসীর কাছে এখন বেড়ানো ও বিনোদনের স্থান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নজরকাড়া সব আধুনিক হোটেল-রেস্তরা। রাজধানীবাসী যেহেতু খাবারের জন্য হোটেল- রেস্তরার দ্বারস্থ হচ্ছেন; তাই তো ব্যবসায়ীরাও যেখানে সেখানে খুলে বসছেন খাবারের দোকান। হোটেল ও রেস্তরা ব্যবসা এখন শুধু উদর পূর্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভোক্তার বিনোদনের স্থান হিসেবেও বিবেচ্য। এ কারণে লাভজনক এ ব্যবসায় জাতীয় দলের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে অভিনয়শিল্পীরাও এখন বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করছেন না। বর্তমানে তরুণ উদ্যোক্তার মধ্যে রেস্তরাঁ ব্যবসার ঝোঁক বেশি থাকায় তারা এগিয়ে আসছেন এই ব্যবসায়। স্বল্প কিংবা মাঝারি মূলধনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক। রাজধানীর হোটেল-রেস্তরাঁ মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এর সঙ্গে জড়িত প্রায় তিন লাখ মালিক-শ্রমিক। রেস্তরাঁগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি ও খাবার তৈরি বাবদ দিনে ব্যয় হয় প্রায় ছয় কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগেও রাজধানীবাসী ফাস্টফুড কিংবা চাইনিজ খাবার খেতে বেইলি রোডের বিভিন্ন দোকানে ভিড় জমাতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে সবই। শহরের প্রধান সড়কগুলোর পাশে এমনকি পাড়া-মহল্লায় খালি জায়গাতেই তৈরি হচ্ছে এসব রুচিশীল হোটেল-রেস্তরাঁ। অনেকে খোলা আকাশের নিচে সবুজ পরিবেষ্টিতভাবে আড্ডা দিতে দিতে খেতে পছন্দ করেন। সেভাবেই বিস্তীর্ণ জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে নগরীর অসংখ্য রেস্তরাঁ। নিজেদের রসুইশালায় ভিন্ন স্বাদের খাবারের আয়োজন নিয়ে এ যেন এক প্রতিযোগিতা। কথায় আছে, ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। আর এসব রেস্তরাঁর জাঁকজমক, সাজসজ্জাই বলে দেয় কে কার আগে ভোক্তা আকৃষ্ট করতে পারে। বিশেষ দিবস উদযাপন ছাড়াও পারিবারিক অনুষ্ঠান পালনসহ নানা উপলক্ষে এখন পরিবার নিয়ে মানুষ হোটেল-রেস্তরাঁয় ভিন্ন স্বাদের খাবার খেতে ছোটেন। শুধু উচ্চবিত্ত ও পেশাজীবী নয়, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কথা মাথায় রেখে নগরীতে গড়ে ওঠা নতুন রেস্তরাঁগুলোয় নানা রকম ছাড়ের ব্যবস্থাও রাখছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির ফলেই এখন রেস্তরাঁ ব্যবসায় জোয়ার। বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীরাও অন্য যে কোন ব্যবসার চেয়ে ভিন্নধর্মী রেস্তরাঁ ব্যবসায় বিনিয়োগে আগ্রহী। বাংলাদেশ রেস্তরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন দেলু জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি হোটেল-রেস্তরাঁ আছে। সেই সঙ্গে ক্রমাগত ভোক্তাসংখ্যা বাড়ছে বলেই রেস্তরাঁর সংখ্যাও বাড়ছে। তার মতে, ভ্যাট কমানোসহ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে এ ব্যবসায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় রেস্তরাঁ ব্যবসার জমজমাট প্রসার ঘটেছে। প্রতিদিন এসব রেস্তরাঁয় নানা বয়সী নারী-পুরুষের সমাগম ঘটছে। এর মধ্যে রয়েছে বনানী, গুলশান, উত্তরা, খিলগাঁও, ধানম-ি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বারিধারা এলাকা। ধানম-ি এলাকায় সাত মসজিদ রোডের চেহারা এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। এর কারণ, এ এলাকায় পুরনো সব ভবনের নক্সা বদলে এখন গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নতুন রেস্তরাঁ। এর মধ্যে আছে ‘ভ্যাপিয়ানো’, ‘নস্টালজিয়া’, ‘ক্যাফে দ্রুম’, ‘ক্রিম এ্যান্ড ফাজ’, এ্যাবাকাস, জিনিজিয়ান। ভিন্ন স্বাদের বিদেশী খাবারের স্বাদ নেয়ার পাশাপাশি অতিথিদের জন্য এসব রেস্তরাঁয় সুন্দর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভোক্তা আকর্ষণে আছে ওয়াইফাইয়ের সুব্যবস্থা। ধানম-ির সাতমসজিদ রোডে ‘লাইলাতি’ নামে একটি ফাস্টফুড ও চায়নিজ রেস্তরাঁ আছে। ইতোমধ্যেই ফাস্টফুডের দোকানটি ক্রেতার আস্থা অর্জন করেছে। পুরোপুরি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীর ওপর নির্ভর করে চলে এটি। এছাড়া ধানম-ির কড়াই গোশত রেস্তরাঁটির রয়েছে জনপ্রিয়তা। এখানেও মাছ-ভাতের পাশাপাশি রয়েছে চায়নিজ ও ফাস্টফুডের। ঢাকার খাবার পাড়াগুলোর মধ্যে পুরনো কিন্তু বিখ্যাত হচ্ছে বনানীর ‘ফিয়েস্তা’, ‘প্লাটিনাম টেরেস’, ‘ক্যাফে ইতালিয়ানো’, ‘সসলিজ’, ‘অফ ট্র্যাক’, ‘রসনা বিলাস’সহ বহু রেস্তরাঁ। এগুলো এরই মধ্যে খাদ্যরসিকদের আস্থা অর্জন করেছে। এক সময় পুরান ঢাকায় নীরব হোটেল, আল রাজ্জাক, হাজীর বিরিয়ানি, ফখরুদ্দিনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভোজনরসিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এখন অলিগলিতে ভালমানের স্থানীয় খাবারের ব্র্যান্ড গড়ে উঠেছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষের খাদ্যাভ্যাস। বাঙালী খাবারের পাশাপাশি বার্গার, পিৎজা, স্যান্ডউইচ এসে হাজির হয়েছে। খাদ্য পরিবেশনের ধরন ও ধারণায় এসেছে ভিন্ন মাত্রা। সম্প্রতি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশেই ৩০০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন গড়ে উঠেছে একটি খাবারপাড়া। বর্তমানে জায়গাটি রীতিমতো বিনোদন স্পটে পরিণত হয়েছে। এখানকার রেস্তরাঁর খাবার, খোলামেলা পরিবেশ ও অধিক প্রস্থের শব্দদূষণহীন সড়কই স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে তিন শ’ ফুটকে। এই খাবারপাড়ায় বর্তমানে ১৫ দোকানে দেশী-বিদেশী হরেক পদের খাবার বিক্রি হয়। এখানকার খাবারের দোকান মালিকদের অধিকাংশই তরুণ। কেউ আবার পড়ালেখার পাশাপাশি খাবারের ব্যবসা করছেন। এসব খাবার দোকানে ম্যাক্সিকান, ইতালিয়ান, ইন্ডিয়ান ও দেশী খাবার স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখেই ফুড আইল্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। আড্ডা, খাবার, বিনোদন এই তিন মেলাতেই ভোক্তা এসে ভিড় জমান এখানে। নতুন ঢাকায় আরেকটি খাবারপাড়া গড়ে উঠেছে খিলগাঁওয়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই এ এলাকায় খাদ্যরসিকের আনাগোনা বেড়ে যায়। এর মধ্যে তরুণ-তরুণীর উপস্থিতিই বেশি। খিলগাঁওয়ে বিভিন্ন রেস্তরাঁর তালিকায় আছে ‘কমিক ক্যাফে’, ‘চেরি ড্রপস’, অলিভার’স রেস্তরাঁ, ‘ভূতের আড্ডা’, ‘সরমা কিং’, ‘গ্রাউন্ড হাউস’, ‘পেটুক’ ও ‘আল ফ্রেসকো’। বর্তমানে রেস্তরাঁর সংখ্যা যত বাড়ছে সঙ্গে খাবারের মান ভাল হচ্ছে। ধরা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে কোন্টির চেয়ে কোন্টি ভাল। পুরনোগুলো রয়েছে তাদের সুনাম নিয়ে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পুরনো রেস্তরাঁর পাশাপাশি নতুনরা খাবারের গুণগত মান আর নিজেদের সুনাম ধরে রাখতে স্ব স্ব কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে চলেছেন। তবে খাবারের দোকান অধিক হওয়ায় ক্রেতা সঙ্কটের কথাও জানান অনেক ব্যবসায়ী। অন্যদিকে ক্রেতা বলছেন, সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্যই ব্যস্ত নগরবাসী ঝুঁকছে বাইরের খাবারের দিকে। গৃহিণীরাও এখন রান্নার ঝামেলার রেশ কাটাতে মাঝেমধ্যে পরিবারসহ বেরিয়ে পড়েন আশপাশের রেস্তরাঁয়। আর কর্মজীবী, ছাত্রছাত্রীর বেশিরভাগই বাইরের খাবারের ওপর নির্ভরশীল। একদিকে মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে বলেই বাইরের খাবারের প্রতি ঝুঁকছে। অন্যদিকে কিছুসংখ্যক উদ্যোক্তা তাদের জীবনমান উন্নত করার জন্যই রেস্তরাঁ ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন ব্যস্ত নগরবাসী উপকৃত হচ্ছেন তেমনি ব্যবসায়ীরাও লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্য যেন কোন ব্যবসায়ী ক্রেতার সঙ্গে দাম ও মান নিয়ে প্রতারণা না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখার আহ্বান জানান অনেক ক্রেতা।
×