ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

বিমূর্ত শিল্পের অবতার

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২১ এপ্রিল ২০১৭

বিমূর্ত শিল্পের অবতার

বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার সূচনালগ্নের পথিকৃৎ শিল্পী ছিলেন যারা তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। যিনি সমকালীন চিত্রকলাকে দিয়েছিলেন নিজস্ব ভাষা ও শৈলী, বিমূর্ত প্রকাশবাদ চিত্রচর্চায় এবং ছাপচিত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় তার মৌলিকত্ব। নির্বস্তুক চিত্রক্ষেত্রের প্রথম সারির দক্ষ শিল্পী ছিলেন, যে দক্ষতার লিরিকগুলো আধুনিকতার সুর এনেছে শিল্পসঙ্গীতে। আবেগের অতিশয্যের চেয়ে চিন্তার সক্রিয়তাই এনেছেন নির্ভুল নিপুণ দক্ষতায় তার সৃষ্ট সকল চিত্রকর্মেই। কখনও আধা বিমূর্ত কখনও বা আধা অবয়বধর্মী আবার কখনও সম্পূর্ণ বিমূর্ত করে আঁকা চিত্র মাঝে ভেসে এসেছে তার নির্বাক করুণ বিষণœতা জড়িত ব্যক্তি আত্ম হাহাকারের আদল। প্রতিটি ছবির গহীন থেকে যেন ঘোলাটে কষ্টের আবছা রঙের মেলমেশ উঁকি দিয়েছে। স্বপ্রীল অভিলাসী আভিজাত্যিক স্বতঃস্ফূর্ততার বিপরীতে সদাসর্বদা ব্যক্তি নিঃসঙ্গতার প্রতিফলন রূপেই শিল্পীর মনের অবচেতনেই কিংবা সচেতনতা বশতই নীরব নিভৃত একাকিত্বের রেখাপাত ঘটেছে তার চিত্রে। ব্যক্তির চিন্তার দাম্ভিকতা থেকে আত্ম টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা, বিষণœতা এবং শঙ্কাকে গ্রন্থায়িত করেছেন তার ক্যানভাস পুস্তকে। প্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তির জীবনের নানাবিধ মিল অন্বেষণে ব্রতী ছিলেন হয়ত। তাই বোধহয় নিসর্গ চিত্রায়নেও অভিঘাত, ছন্দভঙ্গ বর্ণহীন ধূসর উদাসীন কষ্টের কুয়াশা জড়ানো শূন্যতার উপস্থিতি অনুভূত হয়। প্রকৃতির সঙ্গে শিল্পীর একাগ্র নিঃসঙ্গতার কথপোকথনই দৃশ্যায়িত রূপ পেয়েছে। যে একাকিত্বের আবহ নিসর্গ চিত্রতলে মাত্রা নিয়েছে এক ভিন্ন আঙ্গিকে এক নিকাষিত রূপে। প্রকৃতির নতুনত্বের প্রাণসন্ধানে নিমগ্নতার ভেলায় চড়ে বিষাদ বেদনের গা ঘেঁষে সদা সর্বদাই রংকে এলিয়ে দিয়েছেন তার চিন্তা প্রতিফলিত দৃশ্যপটে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সংবেদনশীলতা সংমিশ্রণে গভীর নিমগ্ন আবেগীয় ধীর, শান্ত অথচ বলিষ্ঠ অদৃশ্য কথার ডালা সাজিয়েছেন তার চিত্রের ফুল ঝুড়িতে। স্বতন্ত্র দৃশ্যমানতা থাকা সত্ত্বেও সদাই অদৃশ্য মোহে আবিষ্ট করেছেন। সঙ্গে আত্মœ অন্তর্নিহিত নির্যাসটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন স্বমহিমায় সর্বস্ব ঢেলে সকল সৃষ্টিতে। নির্বিরোধী আত্মœকেন্দ্রিক প্রচারবিমুখ ও নির্জনতা প্রিয় এ শিল্পী তার কৃত শিল্পকর্ম দ্বারা প্রমাণ করে গেছেন ব্যক্তিচরিত্র ও তার শিল্পকর্ম আলাদা কিছু নয়, একই ফ্রেমে আবদ্ধ চক্রায়িত রূপমাত্র। উজ্জ্বল অনুজ্জ্বল রং সংবরণে রেখার আলতো প্রলেপে সময়ের প্রচ-তা ও গতিময়তা উপস্থাপন করেছেন। সর্বগ্রাসী শূন্যতা ও নিয়তির বোধে আক্রান্ত শিল্পীর নিঃসঙ্গতার প্রক্ষেপণ পারিবারিক আবহের ব্যথা থেকেই উদ্ভুত হয়ে চিত্র রূপ নিয়েছে। রং ছড়ানোর যে ভিন্ন আমেজ সঙ্গে ছাপচিত্রের সূক্ষè রেখা ও ফর্মের সংস্থাপনের দক্ষতা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের পথচলাকে আরও সুগম করে। নান্দনিকতাও যেন ময়ূর পুচ্ছের ন্যায় পাখনা মেলেছিল তার অপূর্ব উল্লসিত গতি ও মায়াময় বেদনাতুর শিল্পকর্মগুলোর দ্বারা। সময়ের প্রচ-তায় তলের সঙ্গে অবতলের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দশর্নগত প্রেক্ষাপট তৈরিই ছিল তার ধারা রীতি এই শিল্প মঞ্চে। জীবনের সঙ্গে তার শিল্পের পথচলা ছিল সমান্তরাল রেখার ন্যায়। শিল্পীর প্রথম পর্বের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তেল রং সমেত সৃষ্ট ‘অবগাহন’ শিরোনামের চিত্রটি। কালচে সবুজ, হলুদ ও খয়েরী রঙের সঙ্গে স্পেচুলার সূক্ষè আঁচড় মিলে এক শক্ত সামর্থ্য ও সঙ্গতিপূর্ণ সময়ের জলের স্রোতের ন্যায় বহমানতাকে এঁকেছেন। আর তাতেই দুটি ভাসমান নারীমূর্তির অবগাহনে গা ভাসানোর সংবাদ পৌঁছানোর রূপটি প্রকাশ পেয়েছে পূর্ণতার সঙ্গে। তেল রং আচ্ছাদিত জ্যোৎ¯œা আলোকিত মায়াময় নাটকীয়তার উপস্থাপন দেখা যার তার ‘পূর্ণিমা’ নামক চিত্রে। যাতে আঙ্গিনায় শায়িত মা তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পরম মমতা ভরে আকাশ পানে আলোকিত উচ্ছ্বসিত চাঁদকে আহ্বানের দৃশ্যটিকে বন্দী করেছেন। আধা কিউবিক রীতির প্রয়োগে উপস্থাপন করেছেন চিত্রটি। ক্যানভাসে কখনও কালো রং লেপে দিয়ে অন্ধত্বের অনুভূতিকে দর্শকের কাছে প্রকটভাবে তুলে ধরেছেন আবার কখনও বিষণœনীল, কৃষ্ণ লালে ইঙ্গিতবহ বিষয়ের ফর্মগুলোকে সাজিয়েছেন মাধুর্যতার খামে। ধূসর, তামাটে, পাটকিলে, গেরুয়া বিষণœ রং তাকে প্রভাবিত করত। উষ্ণ রঙের প্রতি ছিল নিষ্ক্রিয়তার ভাব, ফলে তার ছবিতে গোধূলী পরবর্তী ম্লান এবং বিরহজড়িত আবহ লক্ষণীয়। ‘ফুল হাতে বালক’ চিত্রে বালকের চোখে নেই প্রফুল্লতা এবং ফুলকে যেন ঠিক ফুল হিসেবে ধরা যায় না, তবে ছবির গভীরে ঘোর বিষণœতা ব্যাপারটি অনুভূত হয় এক দৃষ্টিতেই। আবেগের পূর্ণ স্ফুরণ হলো বিমূর্ত চিত্রের প্রধান প্রাণ যার দক্ষ আবেদন খুঁজে পাওয়া যায় শিল্পীর সকল বিমূর্ত ধারার চিত্রে। তেল রঙের পাশাপাশি লিথোগ্রাফ মাধ্যমেও তিনি দেখিয়েছেন তার সুষম দক্ষতা। রং নিয়েই হাজির হয়েছেন পাথরের ওপর লিথো মাধ্যমে। বিষয়বস্তুর ভারাক্রান্ততার বিলীন রূপ দেখা যায় তার চিত্রে জাপানী প্রভাব কিছুটা উঁকি দেয় তার লিথো প্রিন্টগুলোয়। তার বেশিরভাগ ছবিই আবদ্ধ অবরুদ্ধ অন্তর্বেদনের কাহিনী বলে যায় তবে শেষের দিকের কাজগুলোতে ভিন্নতা আসে। মৃত্যু দুয়ার থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পরেই এই ভিন্নমাত্রার আলিঙ্গন চোখে পড়ে। লালচে রঙের দ্বারা হয়ত অসুখ থেকে মুক্তি পেয়ে জীবনে ফেরার আনন্দকে তুলে ধরেছেন। শেষ জীবনেই সুখের ছোঁয়ায় রাঙিয়েছেন তাঁর ক্যানভাস দূরে ঠেলে দিয়ে ভুলে ছিলেন অতীত বেদনা। মোহাম্মদ কিবরিয়া দায়বদ্ধতাকে মুক্তি দিয়ে আপন মহিমাকে রাঙিয়েছেন আবেগের ভরা বদনে একক ঐন্দ্রোজালিকার অনুভূতির পরতে পরতে বুনেছেন রেখা, রং ও ফর্মের জমিন।
×