ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফজলুল হক তুহিন

তরুণ লেখকদের সাহিত্য ভাবনা ॥ কবিতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবিক সৃজনসম্পদ

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২১ এপ্রিল ২০১৭

তরুণ লেখকদের সাহিত্য ভাবনা ॥ কবিতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবিক সৃজনসম্পদ

কবিতা কবির সৃজন ও মননের অভিন্ন উৎসারণ। কল্পনা প্রতিভা ব্যক্তি মানুষকে ‘কবি’ করে তোলে। কবির জীবনাভিজ্ঞতা, পাঠাভিজ্ঞতা, নির্মাণ দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে পুঞ্জীভূত ভাব কাব্যভাষায় রূপান্তরিত হয়। সবকিছুর কেন্দ্রে থাকে ভাববিন্দু। এই ভাববিন্দু থেকেই কবিতার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। একটা জীবন সাধনার মধ্য দিয়েই একজন সৃজনশীল মানুষ ‘কবি’ হয়ে ওঠে। এই কবি যেমন সৃষ্টিশীল মানবিক সত্তাসম্পন্ন, তেমনি সমাজেরও মানুষ। সাধারণ মানুষের মতো কবিকেও বেঁচে থাকতে হয় জীবিকা নির্বাহ করে। জীবনযাপনের পথে কবিকে মুখোমুখি হতে হয় নানা ধরনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, সংবেদনা ও সংগ্রামের সঙ্গে। সেখান থেকেই উৎসারিত হয় কবিতার ভাবনাপ্রাণিত শব্দস্রোত। এই শব্দপ্রবাহেই নির্মিত হয়ে যায় কবির স্বতন্ত্র কাব্যভাষা, ভাষার মধ্যে গুঞ্জরিত ছন্দের স্পন্দন, উপমা-প্রতীক-চিত্রকল্প-রূপকের সৌন্দর্য ও কারুকাজ। তাই কবিতা জগতে সবচেয়ে সূক্ষ্মতম ও শুদ্ধতম শিল্প, যে শিল্প জীবনেরই অন্য নাম। ফলে কবি কবিতায় কখনও মানবাধিকারের জন্য উচ্চকিত, প্রেমের জন্য কাতর, কখনও স্বাধীনতার জন্য সন্দীপিত, মা-মাটি-স্বদেশের জন্য মরিয়া, প্রকৃতির জন্য স্বাপ্নিক, জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের উদ্বোধক; সব মিলিয়ে জীবনের জন্য জীবনের গভীরে সচেতন ও ভাবুক শিল্পী। সেজন্য কবিতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবিক সৃজনসম্পদ। ** ঝিনুক ও মুক্তা বহুকাল ধরে আমি এমন সমুদ্রে আছি যে সমুদ্র সারাক্ষণ অশান্ত অস্থির- ক্ষুব্ধ ঢেউ সৈকতের পিঠে অবিরত আছাড়ি পিছাড়ি খায় আমি আজীবন ধাক্কা খেয়ে এখানে ওখানে ছুটেছি আশ্রয়ে ঘূর্ণিঝড় সাইক্লোন ছাড়া কিছুই পাইনি। কোনো কোনো পর্যটক আমাকে গিলেছে আহার হিসেবে আমি দুখের আঘাত পেতে পেতে এখন হয়েছি চেপ্টা স্বজনের শোকে শক্ত হতে হতে খোলস আমার নির্মাণ করেছি বোবা ব্যথার পাথরে তাই এ উত্তাল সাগরের উপকূলে জোয়ার ভাটায় কখনো ভাসছি কখনো ডুবছি আর হৃদয়ে সঞ্চিত করেছি হাজার বছরের নীল বেদনার মুক্তা। নারী, তুমি কি পারবে মুক্তা আঁকা নাকফুল গড়তে পরতে তোমার নাকেই সূর্য হাসে আমার জীবন ঝরতে ঝরতে। ** মেঘবৃষ্টি ঝড়বজ্র সারাদিনমান মেঘ জমা হও নৈঋতে ঈশানে সমস্ত আকাশ জুড়ে ছেয়ে যাও খরার উজানে ছিন্ন ছিন্ন মেঘপুঞ্জ ঝাঁক বাঁধ দৃঢ়তার সুরে শত বছরের দুখে কৃষ্ণবর্ণ হও কাছে দূরে এবার গর্জন তোলো আকাশ জমিন আদিগন্ত ভয়ের জন্তুরা মরে যাক সাহসেরা প্রাণবন্ত কত যুগ খরার দহন, নেই সবুজ অঙ্কুর আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, এই মাটি হোক প্রাণের নূপুর জন্ম নিক প্রত্যয়ের দেবদারু গগন শিরীষ মরা নদীরা আবার কূলপ্লাবী হোক অহর্নিশ কড় কড় ঝড় ওঠো বুকে বোধে শিরায় শিরায় জেগে ওঠা চর ভেঙেচুরে যাক রক্তের ধারায় আগ্রাসী আঁধার চিরে হেসে ওঠো বিদ্যুৎ-উল্লাস আর কত কাল দেখে যাব বলো প্রাণের বিনাশ পদ্মা মেঘনা যমুনা সাক্ষী, সাক্ষী ওই হিমালয় মেঘবৃষ্টি ঝড়বজ্র শেষে হবে রবির উদয়। ** ভার গাড়িটানা মহিষের মতো দগদগে কাঁধের মতন কাল করেছি অনেক পার দুই কাঁধে যন্ত্রণার হিন্দুকুশ হিমালয় বেদনার নীলগিরি নীলাচল বইতে বইতে গগন শিরীষ থেকে কুঁজো বামনের মতো হয়ে গেছি একদম এখন কেঁচোর মতো মেরুদ-হীন হতে হতে মাটির গভীরে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে পাতালে আবাস এই দুঃখভার বয়ে বেড়ানো যে কোনো মানুষের জন্য সর্বনাশ! তাই জীবনই আজ ভারবাহী এক ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে বুকে জমেছে পলাশ রাঙা মেঘ সেই মেঘের মাদল থেকে রক্তরাঙা স্রোতে দুই তীর ভাঙতে ভাঙতে বয়ে গেল তিস্তা পদ্মা যমুনা রূপসা পায়ের পাতায় কৃষ্ণচূড়া জমা হতে হতে খোয়া ওঠা রাজপথ মিশে গেল জীবনের শেষ গন্তব্য পর্যন্ত। জীবন এখন বিষেভরা ভারবাহী একটা পাথর আমি মহাপুরুষের মতো দৃঢ়চেতা ভাববাদী নই মহাবীর রুস্তমের মতো অদ্বিতীয় দুঃখবাহী নই অথবা কখনো হতে পারব না সমুদ্রের মতো নীলকণ্ঠ। জীবনপাথর আজ মৃত্তিকার স্তরে স্তরে গেড়েছে শেকড় গ্লানির বিস্তৃত বটবৃক্ষ বুকে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে অনড়। ** ডালিম কুমার কাল অজগর শিরায় শিরায় ঢুকে সব পথ রোধে চুক চুক করে খায় হিস হিস করে ছাড়ে রোশ পথে প্রান্তরে ঘরে ও বাইরে ফুঁসে ওঠে ক্রোধে। আমাদের ঘর ধু ধু বালুচর কাল অজগর নাচে আর হাসে সৃজনের ধারা মননের চারা বিনাশী ছোবলে করেছে হজম মাঠের আবাদ খোরাকী ফসল খেয়ে ফেলে সব উল্লাসে। মানুষের প্রাণ করে আনচান বুকে হাঁসফাঁস অবিরত রবির উদয় গগনে উধাও হাজার রজনি এসেছে আবার জোনাকির কুপি জ্বলে নিভু নিভু তারাদের মতো। সেই কবে একবার মানুষের কাছে এসেছিল ডালিম কুমার হঠাৎ আলোর ঝরনার মতো বাঁধ ভেঙেছিল মানুষের মন কাল অজগর ছিন্নভিন্ন হয়েছিল বারবার। মানবহৃদয় কৃষ্ণপক্ষে হাঁপাতে হাঁপাতে জীবনবিমুখ মাঝে মাঝে তবু জ্বলে ওঠে প্রাণ : আসতেই হবে ডালিম কুমার মরা গাঙে বান ডেকে গান গেয়ে ময়ূরপঙ্খী ভাসবে আবার। ** বসন্তের সকালে অনেক মরুদিন অনেক অপেক্ষার পিপাসায় হাহাকারে ক্লান্তশ্রান্ত হতে হতে যখন একাকী মন পথিক হয়ে উ™£ান্ত তখন হঠাৎ তুমি এলে সারারাত ঝড়োবৃষ্টির পর বসন্তের সকালে নিসর্গে প্রাণবন্ত বাতাসের মতো সজীব সবুজ পাতাদের আনন্দের মতো উচ্ছ্বসিত মুকুলের মতো আমি গন্ধমাতাল হয়ে গেলাম তোমার সৌরভে তোমার গৌরবে হাঁটাপথে মজনুর মতো হৃদয়ের কার্পেট বিছিয়ে দিলাম তুমি অবিশ^াস করলেও জেনে রেখো কবির কলম সত্য যেমন সত্য আমার কাছে তোমার হৃদয়।
×