ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিধান রিবেরু

সত্যজিতের ‘সীমাবদ্ধ’ ব্যক্তির সীমাবদ্ধতার গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২১ এপ্রিল ২০১৭

সত্যজিতের ‘সীমাবদ্ধ’ ব্যক্তির সীমাবদ্ধতার গল্প

সত্যজিৎ রায়ের তিনটি ছবি কলকাতা ত্রয়ী নামে সুনাম অর্জন করেছে। ছবি তিনটি হলো ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১) ও ‘জন-অরণ্য’ (১৯৭৫)। অনেকে এই তিনটি ছবিকে সত্যজিতের ‘রাজনৈতিক চিত্রত্রয়ী’ হিসেবেও বিবেচনা করে থাকেন। এখানে আমরা আলাপ করব ‘সীমাবদ্ধ’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে, যেখানে মূল চরিত্র শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বরুণ চন্দ। শংকরের উপন্যাস ‘সীমাবদ্ধ’ থেকে একই নামে ছবি নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। তখন প্রতিবেশী দেশে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে। লাখ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। আর পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে চলছে নকশালপন্থী সিপিআই-এমএলের সশস্ত্র সংগ্রাম, তাদের দমনে প্রশাসন কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। মারা পড়ছে বহু তরুণ। ঠিক সে সময়ে, মানে ২৪ সেপ্টেম্বরে মুক্তি পায় ‘সীমাবদ্ধ’। ছবিটি এমন এক ছবি যেখানে কলকাতা শহরের বেকারত্বের বিপরীতে শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জি নামের এক তরুণ যোগ্যতা ও ভাগ্যের বলে একটি কোম্পানির ডিরেক্টর হওয়ার গল্প বলা হয়। গল্পে দেখানো হয় এই তরুণ পদোন্নতি ও সামাজিক মর্যাদার লোভে হীন কাজ করতেও পিছ পা হয় না। শ্যামলের এই চরিত্রটি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির সিদ্ধার্থের একেবারে বিপরীত। বিপরীত এই অর্থে যে সিদ্ধার্থ বেকার, চাকরির জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে সে পুরো ছবিতে। আর শ্যামল মধ্যবিত্ত হলেও ছাত্র ভাল হওয়ার কারণে চাকরি শুধু বাগিয়ে নেয়নি, সেই চাকরির শীর্ষ স্থানেও পৌঁছে যায় সে। সিদ্ধার্থ যেখানে বামঘেষা, শ্যামল সেখানে কোন রাজনীতির সঙ্গেই নেই। সিদ্ধার্থ নিজের পায়ের তলায় মাটি থাকলে অন্যের জন্য প্রতিবাদ করতে জানে, অপরদিকে শ্যামল নিজের পায়ের তলায় মাটি ফিরিয়ে আনতে অন্যের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা শ্যামলেন্দুর ভেতর যেমন তীব্র তেমনি একই বাসনা ধারণ করে তার স্ত্রী দোলন চাঁপা। তাদের একমাত্র পুত্র রাজা তাদের সঙ্গে থাকে না, থাকে বোর্ডিংয়ে। এমনকি শ্যামলেন্দুর বয়স্ক মা-বাবারও ঠাঁই হয়নি আধুনিক বড় ফ্ল্যাটটিতে। হবে কিভাবে? সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখতে যে ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে অন্য উচ্চাকাক্সক্ষীদের দাওয়াত দিতে হয়, পানাহার করতে হয়! তেমনই এক পানাহারের সন্ধ্যায় আলাপ ওঠে কি হচ্ছে কলকাতা শহরে? এই শহরের ‘গ-গোল’ কি করে দূর করা যায়? কলকাতা তো ডুবতে বসেছে! মানে যুব আন্দোলনকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে এখানে। তখন একজন বলল, ‘ওদের ধরে ধরে চাকরি দিয়ে দাও,’ প্রত্যুত্তরে আরেকজন বলল, চাকরি দিয়েই বা লাভ কি, সেখানেও একটা ইউনিয়ন করে বসবে। শ্যামলেন্দু বলছে, ওদের বক্তব্য হলো পুরো ব্যবস্থাটাই পচে গেছে, ওরা চাকরি চায় না। শ্যামলেন্দুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আরেকজন বলল, ওরা বিপ্লব চায়। তৃতীয় ব্যক্তি বলছে, এখন দরকার ডিক্টেটর। শ্যামলেন্দু তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে, বলছে, তরুণদের মধ্যে এই যে একটা অনাস্থা, এটা তো একটা ইউনিভার্সেল ব্যাপার। তখন ওই তৃতীয় ব্যক্তি মানে সৌমেন একটু খেপে বলল, ইউনিভার্সেল মাই ফুট! বিদেশে একটা কিছু চলছে সেটারই অনুকরণে এখানে কিছু চলছে। ওরাও করছে, আমরাও করছি। তখন শ্যামল দেশভাগের আগের ছাত্রনেতা আর পরের ছাত্রনেতাদের মধ্যে পার্থক্য আছে বলে মন্তব্য করে। শ্যামল কি তবে যুব বিদ্রোহের পক্ষে কথা বলছে? সৌমেনের এমন প্রশ্নের জবাবে শ্যামল আর কোন উত্তর দেয় না। এই কথোপকথনের ভেতরেই টুটুল, শ্যামলেন্দুর শ্যালিকা, যে কলকাতায় বহুদিন পর বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তার প্রতিক্রিয়া দেখান সত্যজিৎ। ঘটনাক্রমে দর্শক জানতে পারে টুটুল যে ছেলেটিকে ভালবাসে সে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই ওই আলাপে যুব বিদ্রোহকে যখন খাটো করা হচ্ছিল বিষয়টি ভালভাবে নেয়নি টুটুল। ব্যাস অতটুকুই। এছাড়া আর কোন জায়গায় কলকাতার তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে সেভাবে কোন আলাপ নেই, কোন ঘটনাও দেখানো হয় না। শুধু আরেক জায়গায় বলা হয়, মাঝে মধ্যেই দুমদাম বোমাটোমা ফুটছে শহরে। কারা ফুটাচ্ছে সেটা দর্শক আন্দাজ করে নেন। অবশ্য ক্রিশ্চিয়ান থমসনকে দেয়া সাক্ষাতকারে সত্যজিৎ নিজেই খোলাসা করেছেন বিষয়টিকে। তিনি বলেন, ‘ওই বোমা বিস্ফোরণগুলো হচ্ছে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লড়াই। ... তারা সত্যিকার লক্ষ্য বস্তুগুলোকে আক্রমণ করত না, যেমন বৃহৎ শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে বোমা ছুড়ত না, কেন-না তাতে তাদের কিছু হারাবার ভয় ছিল, বরং তারা নিজেদের মধ্যেই লড়ত।’ এটা কি সত্যজিতের ক্ষোভ যে বামপন্থীরা বড় শিল্পপতিদের উদ্দেশ্যে বোমা ছুড়ত না? এ কথা থেকে মনে হয় সত্যজিৎ শিল্পপতিদের প্রতি বেশ খাপ্পা। কিন্তু এই ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতেই দেখুন না অভিজাত শ্রেণীর বিলাসি জীবন দেখানোতেই যেন আনন্দ নির্মাতার। পুরো ছবিতে কলকাতার অভিজাত কর্পোরেট সমাজের ক্লাব, ক্যাবারে নাচ, বিউটি পার্লার, পার্টি, শাড়ি, পদোন্নতি, রেসের ময়দান, জুয়া ইত্যাদি দিয়ে ঠাসা। কোথায় মূল উপন্যাসে তো টুটুল কলকাতার পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। সে দেখে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কলকাতাকে, সে দেখে বামপন্থী আন্দোলনের কলকাতাকে। কোথায় সেসব দৃশ্য? টুটুলকে কেন শুধু ঘোড়ার দৌড়, মদের পার্টি আর ক্যাবারে নৃত্যের আসরে দেখা যায়? কোন শ্রেণী অবস্থানের কারণে রাজনীতি বিমুখ সত্যজিৎ টুটুলকে এভাবে বড়পর্দায় তুলে ধরেছেন? রেসের ময়দান ঘোড়ার দৌড়ের মতো শ্যামলেন্দু যেন উচ্চবিত্ত হওয়ার দৌড়ে লিপ্ত। একই রকম মেটাফোর পাওয়া যায় শেষের দিকেও, সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠার দৃশ্যে। সেখানে অবশ্য সে উঠতে উঠতে ক্লান্ত। তো শ্যামলেন্দুর এই উপরে ওঠার ব্যাপারটি কিন্তু শ্যালিকা টুটুল বেশ উপভোগই করে বলা যায়। কিন্তু টুটুল প্রথমে বুঝতে পারেনি তার পূর্ব পরিচিত এই শ্যামলেন্দু নিজের সুনাম অক্ষুণœ ও পদোন্নতির লোভে অসৎ কাজও করতে পারে নির্দ্বিধায়। সে কারখানাতে গ-গোল বাধিয়ে দেয়, যার ফলে ডাকা হয় কৃত্রিম ধর্মঘট। এই ধর্মঘটের এক ফাকে কারখানায় শ্যামলেন্দুর ইশারাতেই ফাটানো হয় বোমা। এতে আহত হয় কারখানার এক পুরনো দারোয়ান। আরেকটু হলে বেচারা মরতেই বসেছিল। কিন্তু তাতে কি? এই গ-গোলের কারণে কারখানা লক-আউট করা হয়, সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। এতে কারখানারই লাভ হয়। কারণ চালানের কয়েকদিন আগে পাখায় কিছুটা সমস্যা ধরা পড়ে। আর এতে বাতিল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় হাজার হাজার পাখার রফতানি আদেশ। এমন অবস্থায় একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ক্রেতাদের বোঝানো হয় কারখানায় ঝামেলা চলছে। মাল পাঠাতে দেরি হবে। এই দেরি মানে কিছুটা সময়, এরই মধ্যে পাখার ত্রুটি সারিয়ে ফেলা যাবে। এমন চালে খুশিই হয় কারখানা কর্তৃপক্ষ, পুরস্কৃত হয় শ্যামলেন্দু। বহু আকাক্সিক্ষত পরিচালকের পদ পেয়ে যায় সে। কিন্তু শ্যালিকা টুটুল, যার সঙ্গে শ্যামলেন্দুর ভাললাগার একটি সম্পর্ক ছিল, তার চোখে সে ধরা পড়ে যায়। লজ্জা পায় শ্যামলেন্দু। টুটুল ফিরিয়ে দেয় শ্যামলেন্দুর ধার দেয়া ঘড়িটি। এই লজ্জা পাওয়ার ভেতর দিয়েই শেষ হয় ছবিটি। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘কলকাতা’ নামের এক পত্রিকায় সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘এখানকার ছাত্র বিক্ষোভের বিশেষ কোন চেহারা নেইÑ অনেকগুলো চেহারা মিশে আছে।’ পরবর্তীকালে ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে এই চিন্তার প্রতিফলন আমরা পেয়েছি, ওই পানাহার দৃশ্যে। একই সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ আরও বলছেন, ‘রাজনৈতিক চেতনা বলতে তো রাজনীতি যারা করে তাদের ব্যর্থতার চেতনাও হতে পারেÑ যা ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এখন। রাজনীতি সম্বন্ধে একটা ডিসিলিউশমেন্ট ছাড়া তো আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। ইন জেনারেল, রাজনীতি বলতে আমরা যেটা বুঝি এবং রাজনীতি যারা করছে সে সব লোকের চেহারা আমরা প্রায়ই দেখি আর কিÑ আমার মনে হয় আশপাশে কী ঘটছে সে সম্বন্ধে ভীষণভাবে একটা সচেতন হওয়া দরকার।’ যে রাজনীতির ভেতর দিয়ে ষাট কি সত্তরের কলকাতা যাচ্ছিল সেই রাজনীতিতে আস্থা ছিল না সত্যজিতের, তাই বলছিলেন মোহভঙ্গের কথা। কিন্তু কোন মোহ, কাদের মোহ? কাদের রাজনীতি ভাল লাগছিল না সত্যজিতের? কংগ্রেসের না তিন বামপন্থী দলের? আসলে গোটা রাজনীতিকেই তিনি পছন্দ করতেন না। ১৯৭২-৭৩ সালে প্রকাশিত সাইট এ্যান্ড সাউন্ড পত্রিকার সাক্ষাতকারে তিনি বলছেন, ‘আমি কখনই রাজনৈতিক বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলাম না। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই আমার ছবিতে রাজনৈতিক বিষয় আনিনি।’ রাজনীতির প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে সৌমেন বিপ্লবী তরুণদের অবস্থানকে ‘মাই ফুট’ বলেন, একই কারণে টুটুলের যে প্রেমিক, রাজনৈতিক কর্মী, তাকেও নির্মাতা রাখেন দৃষ্টির আড়ালে। ঠিক একই কারণে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে সিদ্ধার্থের ছোট ভাইকেও করে রাখা হয়েছিল একটি পার্শ্ব চরিত্র মাত্র। রাজনৈতিক বিষয় তো পছন্দ করতেনই না, থমসনকে দেয়া সাক্ষাতকারে, সত্যজিৎ সরাসরিই বলেছিলেন, ‘আমি বামপন্থায় বিশ্বাস করি না।’ হয়ত অন্য কোন পন্থায় আস্থা ছিল রায়ের, সেই পন্থার নাম হতে পারে ব্যক্তিবাদ, সমষ্টি নয়, ব্যক্তিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন রায়, বিশেষ করে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন, বিমুখ, অনেকটা আত্মমগ্ন, স্বার্থপর চরিত্রকেই কলকাতা ত্রয়ীর মুখ্য চরিত্র হিসেবে হাজির করেছেন সত্যজিৎ। ‘সীমাবদ্ধ’ চলচ্চিত্রের শ্যামলেন্দুর জগত যেমন নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার গ-িতে সীমাবদ্ধ, তেমনি বলতে হয় সত্যজিতের রাজনৈতিক ভাবনাও রাজনীতি থেকে দূরে ব্যক্তিবাদের ঘেরাটোপেই সীমাবদ্ধ।
×