ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সায়মন স্বপন

সাযযাদ কাদিরের কবিতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২১ এপ্রিল ২০১৭

সাযযাদ কাদিরের কবিতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

কবিতায় শব্দ নিয়ে খেলেন কবি। শব্দের সঙ্গে শব্দের মিলন ঘটিয়ে কাব্যিক-রসায়ন তৈরি হয় যা পাঠকের খিদে মেটায়। তবু পাঠকের খিদে পুরোপুরিভাবে কোন কবিই মেটাতে পারেন না। কবিতায় ছন্দময় ভাবের বিন্যাস, অনুভূতির যোজন-বিয়োজন, চিন্তার কুলতলায় হাঁটাহাঁটি, চিত্রকল্প বা দৃশ্যকল্পের আঁকিবুঁকি, শ্রুতিমধুরতা, নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি, কাব্যিক গঠন, পরিশীলতা ইত্যাদি যুগে যুগে স্থান পেয়ে আসছে। শব্দের ছন্দায়িত সময় ধীরে ধীরে বিবর্তিতও হয়েছে। বিবর্তনের ধারায় বাংলা কবিতা পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন কবি সাযযাদ কাদির (১৯৪৭-২০১৭)। সাযযাদ কাদির ছিলেন ভাববিন্যাস ও মুক্তগদ্যের সহজ মানুষ। তিনি সাহিত্যের সাহসী উচ্চারণে ভূমিকা রেখেছেন নিরলসভাবে। তাঁর সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যায় জীবন ও জগতের এক মৌলিক রসায়ন। যে মানুষের সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় নেই, তিনি সাযযাদ কাদির। সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনবদ্য ভালবাসা পাঠককে পুলকিত ও উৎসাহিত করে। তাঁর কবিতায় ব্যঞ্জনা, বিশ্লেষণ ও দ্যোতনাধর্মী বিষয় উঠে এসেছে। কবিতার জন্য কতটা উদাসীন হওয়া যায়, কতটা বাস্তবিক হওয়া যায়, তা আমরা বুঝতে পেরেছি সাযযাদ কাদিরের কবিতায়। তিনি বাস্তবতাকে সামনে রেখে কবিতার খোরাক মেটানোর চেষ্টা করেছেন। পাঠক তাঁর কবিতায় খুঁজে পেয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। আধুনিক কবিতার নামে তাঁর কবিতায় কোন মেদবহুল শব্দচয়ন পরিলক্ষিত হয় না। কবিতার শরীরকে পরিশীলিত, গঠনশৈলী। কাব্যিক ও নান্দনিক করতে তাঁর কোন কৃপণতা ছিল না। কবিতার জন্য তিনি ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছেন, নিজেকে সমর্পণ করেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। সাযযাদ কাদির ষাটের দশকের কবি। তিনি গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক এবং সাংবাদিক হিসেবেও পরিচিত। তিনি ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে টাঙ্গাইল জেলার মিরের বেতকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬ এপ্রিল, ২০১৭ তারিখে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তার কর্মজীবন শুরু শিক্ষকতার মাধ্যমে। এরপর সাংবাদিকতা আত্মনিয়োগ করেন। পেশাজীবনের পাশাপাশি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশুতোষ বিষয় নিয়ে লিখেছেন। এছাড়া সম্পাদনা, সংকলন এবং অনুবাদও করেছেন। তাঁর গ্রন্থ রচনার ঝুলিতে স্থান পেয়েছে ৬০টির বেশি গ্রন্থ। প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- যথেচ্ছ ধ্রুপদ (কাব্যগ্রন্থ-১৯৭০), চন্দনে মৃগপদচিহ্ন (গল্পগ্রন্থ- ১৯৭৬), লাভ স্টোরি (অনুবাদ- ১৯৭৭), অন্তর্জাল (উপন্যাস-২০০৮), রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন (গবেষণা- ২০১২), রবীন্দ্রনাথ : মানুষটি (গবেষণা- ২০১২), নারীঘটিত (প্রবন্ধ- ২০১২), বৃষ্টিবিলীন (কাব্যগ্রন্থ- ২০১২)। এছাড়াও রাজরূপসী, হারেমের কাহিনী, পৃথিবীর প্রিয় প্রণয়ী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধসমগ্র, বেগম রোকেয়া প্রবন্ধসমগ্র, প্রেমপাঁচালী, অপর বেলায় উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ভারত থেকে ২০১০ সালে ‘বিষ্ণু দে’ পুরস্কার, ২০১৩ সালে ‘শৈবভারতী’ পুরস্কার এবং বাংলাদেশ থেকে ২০১৬ সালে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’ পুরস্কার পান। সুদূরপ্রসারী চিন্তার জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর কবিতায় তেমনি ধরনের দ্যোতনা লক্ষ্য করা যায়। তুলনা করা যায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে। সত্যিকার অর্থে, কবিতার হাত ধরে তিনি দেখিয়েছেন বর্তমানের শরীরে ভর করে আগামীর শুয়ে থাকা সকালকে কিভাবে সমকালের সঙ্গে সংযোজন করা যায়। তাঁর ‘সামনে রোদ্দুর’ কবিতায় তিনি বলেছেন এভাবে- ছায়া কোথায়? হাত-পা ছড়িয়ে উদোম হয়ে রোদ্দুর শুয়ে আছে সবখানে। কাল রাতে বৃষ্টি ছিল, আজ একটু ছিটেফোঁটা নেই গাছের পাতায়। কবিতায় কবি আর পাঠকের একটি সমন্বয় ঘটনোর চেষ্টা করা হয় বৈকি। কবির চিন্তার সঙ্গে পাঠকের চিন্তার একটি সামঞ্জস্যতা তৈরি হয় কখনও কখনও। কবিতা পাঠ করার পর পাঠকও হারিয়ে যেতে পারেন তার অতীতের কোন এক রোমাঞ্চকর মুহূর্তে, এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে যদিও কবি কল্পনার আশ্রয় নিতেই পারেন। তবুও, পাঠকের একটি অতীতের খোরাক হিসেবে যোগান দেয়। বোধ আর দর্শন বিবেচনা করলে গুণগত মানও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। আরও একটি কবিতার কথা তুলে ধরা যেতে পারে। এখানে কবির সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলোর স্মৃতিতে কিভাবে একজন পাঠক অতীতের সঙ্গে মিশে যেতে পারে তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করা যাক। সাযযাদ কাদিরের ‘চুপচাপ’ কবিতায় পাওয়া যায়Ñ খুব মনে আছে তোমার সাজগোজÑ তোমার খোঁপার ফুল, মালা পরনের ঢাকাই শাড়ি . . . . . . . . . . . মনে নেই শুধু তোমার সেই প্রত্যাখ্যানের পর কেমন কি হয়েছিল আমার। . . . . . . . . . . . . . . . . ক্ষোভ দুঃখ ব্যথা বেদনা অভিমানÑ এ সব মন থেকে ধুয়ে মুছে ভেসে গেছে কবে! কবিতায় তিনি বাস্তবতাকে সামনে রেখে পরাবাস্তবতার বিষয়টিও তিনি তুলে এনেছেন। যেমন ‘খাদ্য তালিকা’ কবিতার কথা বলা যায়Ñ আমার একটি হাত সহসা দীর্ঘ হতে-হতে জ্যোৎ¯œাকে অতিক্রম করে যায়; যেন হাত নয়, যেন হাতিয়ার, যে ত্বকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা এক স্বয়ংক্রিয় হোস্পাইপ। রূপক শব্দ বা উপমার আশ্রয় নিয়ে কবি এখানে একটি বিষয়ের সঙ্গে অন্য একটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। পার্থিব জীবনের বেশ কিছু বিষয় আমরা এড়িয়ে যাই, অথচ যা আমাদের সামনে হরহামেশা ঘটেই চলেছে; সে সবের বিষয় নিয়ে কবি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। যেন, বিষয়গুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর মতো। মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ব্যক্তি-সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, যা সামান্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধিত হলে বয়ে আনতে পারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ফল। তেমনি একটি কবিতা দিয়ে এই মননশীলতার পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে ধরা হয়। কেননা, জাতি বিশ্বাস করেÑ যে কোন সৃষ্টির নেপথ্যে কোন না কোন রহস্য লুকিয়ে থাকে। কবিও সেই সৃষ্টির পেছনে দৌড়াতে চায় আমরণ। রহস্যকে নিজের সৃষ্টির ভেতর গেঁথে দেয়া হয় বিনি সুতার মালা দিয়ে। সাযযাদ কাদিরের কবিতায় পাঠক তেমনই গন্ধ পেয়ে থাকে। ‘কবির আঙ্গুলগুলো’ কবিতায় দেখতে পারিÑ আমাদের ভাবনাগুলো কেমনÑ জানো? চারপাশের এই আলো, হাওয়া, পানির মতো! ওরা ঠিকই আমাদের ভেতর থেকে বাইরে যাওয়ার পথ খুঁজে নেয়... তারপর সত্যি-সত্যি বেরিয়ে পড়ে... ছড়িয়ে যায় এদিক-ওদিক। কবিতাকে নিজস্ব সীমানার মধ্যে না রেখে কবিতার ব্যাপ্তি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা সাযযাদ কাদিরের কবিতায় পাঠক লক্ষ্য করেছেন। সংস্কারের পক্ষে তার কবিতা মাথা উঁচিয়ে বেঁচে আছে। আমরা সংস্কারের পক্ষে লিখে চলেছি, এর ধারাবাহিকতাও রক্ষা হবে। দেশ ও দশের জন্য হিতকর এমন প্রথার জন্য লেখকগণ লিখে চলেছেন, যা হিতকর নয় এমন প্রথার জন্য প্রথাবিরোধী লেখনীও হচ্ছে। সাযযাদ কাদিরের কবিতায় তেমন প্রথাবিরোধী কথামালা পরিলক্ষিত হয়। যাপিত জীবনের নিছক সত্য কথাগুলো তার কবিতায় উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। যা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী সেসব কথামালা আবারও ফিরে দেখা যাক। এ শহর থেকে চলো সব দুঃখ নিয়ে যাই। এই ভাঙা অলি-গলি উপচে পড়া নর্দমা-আবর্জনা এই যানজট বিদ্যুত বিভ্রাট গ্যাস-পানি সঙ্কট বাজারে পাগলা ঘোড়া ফাটকাবাজারে নিঃস্ব আত্মহন্তা -এত সব দুঃখ নিয়ে, চলো, এখনই চলে যাই। (দুঃখ নিয়ে যাই) কবিতায় লক্ষ্য করা যায়, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যথা-বেদনা-কান্নার সঙ্গে মিশে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় কবি তুলে ধরেছেন। কথাগুলো আমরা জেনেও চুপচাপ থেকে নিজেদের পকেটের কথা ভেবে দিনাতিপাত করছি। অথচ পাশের বাড়ির শিশুটির কান্না শোনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কানে শিমুল তুলা দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ছি প্রতিদিন। সকালেই ছুটছি বিভিন্ন ধান্দায়, ফিরছি বাড়িতে, আবার ঘুমিয়ে পড়ছি। এসব নিয়ে কথা বলার যেন কেউ নেই। এসবের জন্য একটি কবিতাই যথেষ্ট নয়। তবু এভাবেই বার বার কবিতার জন্ম হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। আমরা রোজ সত্যতার মুখোমুখি হচ্ছি কিন্তু সত্যের পাশে দাঁড়াচ্ছি কতজন? ভেবে নিচ্ছি- এ সবই নৈমিত্তিক, হরহামেশাই হবে। সুতরাং দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রটা তৈরি হচ্ছে খুব নামমাত্র। তাঁর আকাশের দিকে হাত কবিতায় লক্ষ্য করা যায়Ñ এ সবই চলছে, চলে আসছে। তিনি বলেন, আমার কথা মানতে হবে। আমি ঘাড় ত্যাঁড়া করে বলি, কিসের কি কথা? কিসের মানামানি? তিনি টেবিল চাপড়ে বলেন, মানতেই হবে। আমি গর্জে উঠি, মানি না- মানব না। তিনি ছাড়েন হুঙ্কার, তবে রে...? নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে কবিতাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রাখা সব মানুষের ভাগ্যে জোটে না, যেটা জুটেছে সাযযাদ কাদিরের বেলায়। কবিতার জন্য ভালবাসা বরাদ্দ রাখতে হয় আলাদাভাবে, কেননা কবিতাকে যেনতেনভাবে ভালবাসলে কবিতা কবির আঁচলে ধরা দেয় না। কবিতার জন্য ধ্যানস্থ হতে হয়। যে ধ্যানমগ্নতার চিত্রকল্প বা দৃশ্যকল্প এই কবির কবিতায় খুঁজে পাই। সমকালীন অর্থনীতি, রাজনীতি, মানবাচরণ, সংবেদনশীল সময় ও মধ্যবর্তী বিশ্লেষণ সবই অনায়াসে তার কবিতার শরীরে তরতর করে উঠে এসেছে।
×