ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২১ এপ্রিল ২০১৭

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

পূর্ব প্রকাশের পর হেলসিংকি ফিনল্যান্ডের দক্ষিণের রাজধানী শহর। ব্যালটিক সাগরের অববাহিকায় গ্লালফ্ অব ফিনল্যান্ড পেনিনসুলায় অবস্থিত। অন্যান্য নরডিক দেশ থেকে ফিনল্যান্ড কিছুটা ভিন্ন, দেশটির একদিকে ব্যালটিক সাগর, গ্লালফ্ অব বথনিয়া এবং গ্লালফ্ অব ফিনল্যান্ড। অন্যদিকে সুইডেন, নরওয়ে এবং রাশিয়ার সীমান্ত দ্বারা পরিবেষ্টিত ইউরোপ মহাদেশের সব থেকে উত্তরের এই দেশটি দীর্ঘদিন ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছত্রছায়ায় থেকে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণে সোভিয়েত ঘরানার দেশ হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয় সেই থেকে ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ইউরো কারেন্সিও তারা গ্রহণ করে। মাত্র ৫.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা এবং ৩৩৮,৪২৪ স্কয়ার কিলোমিটার আয়তনের দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের উপায় হিসেবে টিম্বার রফতানি এবং নোকিয়া মোবাইল ফোনই ছিল অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু ২০১২ খ্রিস্টাব্দের পর টিম্বার রফতানিতে ভাটা পড়ে আর নোকিয়া মোবাইল ফোন বিশ্বের বড় ফোন প্রস্তুতকারী কেম্পানি বাজার দখল করে নেয় অত্যাধুনিক ফোন আবিষ্কারের মাধ্যমে। ফলে দেশটি সাময়িক আর্থিক সঙ্কটে পতিত হয়। তবে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের কোন অভাব নেই। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে ঃরসনবৎ, রৎড়হ ড়ৎব, পড়ঢ়ঢ়বৎ, ষবধফ, ুরহপ, পযৎড়সরঃব, হরপশবষ, মড়ষফ, ংরষাবৎ, ষরসবংঃড়হব ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি বাণিজ্যের প্রসারের কারণে ফিনল্যান্ড বেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির মাথাপিছু আয় ৪১,০০০ হাজার ডলার। উন্নতমানের কারিগরি শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রফতানিতেও ফিনল্যান্ডের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। উপরন্তু পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে এই শিল্প। লক্ষ্যবিহীন পদচারণার আবিষ্কার করা গেল এখানে যতগুলো দর্শনীয় স্থাপনা আছে তার সবই এই ফেরি টারমিনালের সংলগ্ন এবং আমাদের হাতে যতটুকু সময় আছে তাতে করে এগুলোই আমরা দেখে শেষ করতে পারব কিনা সন্দেহ। আনমনে হেঁটে চলেছি বিক্ষিপ্তভাবে আমরা সকলেই, আমাদের কোন নেতা নেই এখন, নেই কোন গাইড। গাইড যিনি আছেন তিনি এখন অনেক ব্যস্ত তার পতিদেবতার সঙ্গ দিতে। আমরাও সেটা চাই। ওদেরই তো এখন সময়। ওরাই তো আনন্দ হই হুল্লোল করে বেড়াবে। আমরা সেই কোন সকালে সে সব দিন কালের গহ্বরে বিলিয়ে দিয়ে এসেছি তার কি খবর রাখার সময় আছে। এই দুই ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাষাভাষি যুগলের অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করছে। অনন্ত যতটুকু কাছে থেকে দেখার আমার সুযোগ হয়েছে, অন্যদের কাছে থেকে জানার সুযোগ হয়েছে সেই আলোকে। আমরা বাঙালীরা যারা স্থায়ীভাবে বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছি পরিবার পরিজন ছেলে মেয়েসহ, তাদের কোন ছেলে কিংবা মেয়ে ভিন দেশের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা শুনলে বিষয়টাতে প্রথমেই কোথায় যেন একটু খটকা লাগে। মনে প্রাণে মেনে নিতে আরও সমস্যা হয়। আমি নিজেও যে সেই সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি হলপ করে বলতে পারব না। তবে এই ধরনের রিলেশনশিপের ক্ষেত্রে অস্বাভাকিতা বলে আর মনে হয় না। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ছেলে মেয়েদের এই ধরনের সম্পর্ককে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার অনন্ত মনে হয় না। তারা সম্পর্ক করার প্রয়োজন হলেই সম্পর্ক করে আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সম্পর্ক শেষ করতে একটুও বাধে না। বিয়েটা একটা আনুষ্ঠানিকতা এবং কিছুটা আইনী বাধ্যবাধকতায় জড়িয়ে পড়া। তবে সেই অর্থে লিভিং টুগেদারের মধ্যে ওই বাধ্যবাধকতা ছাড়া আর তেমন কোন পার্থক্য নেই। বিয়ে করতে ও লিভিং টুগেদার করতে যেমন সময় লাগে না তেমনি ছাড়াছাড়ি করতেও সময় লাগে না। একদিন সকালে বালিশ কাতা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই সব শেষ হয়ে গেল, অন্যথায় নিদেন পক্ষে কোর্টের একটা কাগজ। এসব নিয়ে কোন পক্ষকে তেমন একটা আক্ষেপ করতে কখনও দেখা যায় না। এদের কাছে বিয়েটা নিতান্তই একটা ছেলে খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব বিষয় অবতারণা করার একটা কারণ আছে। কারণটা এসবের যে ব্যতিক্রম আছে সেই ব্যতিক্রমী বিষয়টাই আগ্রহ নিয়ে বলতে মনটা উসখুশ করছে। যে কথা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, ডাক্তার দাদার মেয়ের বিয়েতে একবার স্কটহোমে গিয়েছিলাম, সেই যাওয়াটা ছিল এই ডাক্তার দিশাখী এবং প্রকৌশলী অস্কারের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে। বিদেশ বিভূঁয়ে বাঙালী হিন্দুদের বিয়ের সকল কঠিন ও জটিল আচার অনুষ্ঠান শতভাগ অনুসরণ করে বিয়ে সম্পাদন করা যেতে পারে এমন নজির দ্বিতীয়টি দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা জানি না। আমি নিজেও পেয়েছিলাম বিশেষ অতিথির সম্মান। গায়ে হলুদ, গঙ্গা ¯œান, সাত পাক, কলা গাছের ছাদনা তলা, (কলা গাছ আনা হয়েছিল সেই ক্যারিবিয়া থেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায়) বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ কোন কিছুতেই কোন রকম ক্রটি রাখা হয়নি। ছেলেকে ধূতি পরানো এবং বিয়ের মন্ত্রের বিদঘুটে সংস্কৃত উচ্চারণের ইংরেজী তরজমা করে ছেলেকে দিয়ে তার উচ্চারণের বারবার ট্রেনিং দেওয়া ও ধূতি পরার মহড়া সবই করা হয়েছে। কোথাও ফাঁকি দেওয়ার অবকাশ দেওয়া হয়নি। বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় কি ধকলটাই না গেছে বেচারা অস্কারের ওপর দিয়ে তার পছন্দের পাত্রীটিকে বিয়ে করতে গিয়ে। প্রেম করার আগে বিয়ের এ সকল কুটিল জটিল প্রক্রিয়াদির তথ্য তার জানা থাকলে প্রেম করত কিনা সন্দেহ ছিল। তবে মনে প্রাণে সব কিছু মেনে নিতে তার যে কোন আন্তরিকতার অভাব ছিল না সেটা তার বিয়ের অনুষ্ঠানের দীর্ঘ সময় ধরে প্রাণজ্জ্বল মুচকি হাসিটাই প্রমাণ করে। এ তো গেল বিয়ের অনুষ্ঠানের বিবরণ। এবার বলি তার পরে ঘর সংসারের গল্প। এরই মাঝে দুটি বছর অতিবাহিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে আর দেখা সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার প্রথম বিয়ের পর তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, সেই প্রতীক্ষায় স্কটহোমে ডাক্তার দাদার বাড়িতে তাদের আগমনের প্রহর গুনছি। এমন সময় মেয়ে জামাই এসে হাজির। গাড়ি থেকে নেমেই বাঙালী কায়দায় গড় হয়ে শ্বশুর শাশুড়িকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ও সহজ সরল ভাষায় বাবা মা সম্বোধন করাতে আর বুঝতে বাকি রইল না যে, স্পানিশ ছেলে অস্কার আর দশজন বাঙালী জামাই থেকে আচার আচরণে কোন অংশে কম নয়। গুরুজনদের সম্মান, আদব কায়দা ইতোমধ্যে সবই শিখে ফেলেছে। চিত্রা বৌদির কাছে আরও যা যা শুনলাম তাতে করে ওর প্রতি শ্রদ্ধা আন্তরিকতা আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল। অস্কার যখনই এ বাড়িতে আসে কখনই জামাই আদর তো প্রত্যাশা করেই না বরং তার শ্বশুর শাশুড়িকে টেক কেয়ার করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটুও অলস সময় কাটাতে তার ইচ্ছা করে না। হয় বাগান পরিচর্চা করা বাগানে জল দেওয়া কিংবা রান্নার কাজে সময় ব্যয় করতে, বাঙালী রান্না শিখতে সময় চলে যায়। এমন জামাই এ যুগে ক’জনের ভাগ্যে জোতাও আবার বিদেশী জামাই। চলবে...
×