ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ জাভেদ হাকিম

ঘুরে এলাম চন্দ্রদ্বীপ

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২১ এপ্রিল ২০১৭

ঘুরে এলাম চন্দ্রদ্বীপ

চন্দ্রদ্বীপ-বরিশালের পূর্ব নাম। কালের পরিক্রমায় সে দিনের চন্দ্রদ্বীপই আজকের বরিশাল। বরিশালের ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। বরিশালকে দেশের শস্যভা-ারও বলা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা শুনলে খুব সহজেই বোঝা যায়, উনি যে বরিশালের। মুই বরিশাইল্লা পোলা। ভার্সিটি লাইফে বরিশাল অঞ্চলের বন্ধুদের মুখ থেকে এমন ভাষাগুলো শুনতে বেশ লাগত। সেই বেশ লাগা থেকেই মনের কোণে জমা হয়েছিল তাদের প্রতি এক ধরনের ভালবাসা আর ভালবাসা থেকেই এবার যাই তিন কন্যা আর মাকে নিয়ে কীর্তনখোলা নদীর তীরে কবি জীবনানন্দ দাসের বরিশাল শহরে। একসময় প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবেও বরিশালের পরিচিতি ছিল। সেখানে যাওয়ার আরও একটি কারণ ছিল, আমার ভগ্নিপতি ডাক্তার আওলাদ হোসেনের বর্তমান কর্মস্থল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। ব্যাটে বলে মিলে যাওয়ায় ভ্রমণে যাবার মোক্ষম সুযোগটি এবার আর হাত ছাড়া করিনি। বিকেল ৩টার ওয়াটার বাসে চড়ে রাত ৯টায় গিয়ে নামি বরিশাল লঞ্চ ঘাটে। মাঝের কয়েক ঘণ্টা বিলাসবহুল ওয়াটার বাসে কেটেছে বেশ। তিন বছরের ভাগ্নি মাহাদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বোনজামাই ওয়াটার বাসে পৌঁছার আগেই তিনি ছিলেন লঞ্চঘাটে হাজির। ঘাটে ভিড়ার পর নানু-মামুকে পেয়ে ভাগ্নিও বেশ উৎফুল্ল। অটো’তে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের বাসায় পৌঁছে যাই, প্রথম দর্শনেই ভাল লাগল ঘাট হতে বাসা পর্যন্ত যেতে রিক্সার কোন জট না দেখে। ঘরে গিয়ে সাফসুতর হতে হতেই ডাইনিংয়ে পরিবেশন করা হয় হরেক পদের খাবার। গোগ্রাসে সাবাড় করি বোনের হাতে রান্না করা যত সব ভিন্ন রকমের মজাদার খাবার। খানাপিনা সঙ্গে আড্ডা, অনেক রাত অব্দি জম্পেশ মুহূর্ত কাটিয়ে বিছানায় যাই। ফ্রেশ একটা ঘুমের পরে, সকালে জানালা দিয়ে তাকাতেই রোদের তাপে ভড়কে যাই। আমি না হয় বৈরী আবহওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব কিন্তু আজকের ঘোরাঘুরির সঙ্গী হবে আমার মা, তাই দিনের প্রথম প্রহর বাসাতে কাটিয়ে দুপুরের পর বরিশালের জনপ্রিয় বাহন মাহেন্দ্রতে চড়ে ছুটি ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী দুর্গাসাগর দীঘি। সুনসান নিরিবিলি পিচঢালা পথে মাহেন্দ্র চলে তার আপন গতিতে। এই প্রথম মাহেন্দ্রে চড়ার অভিজ্ঞতা, তাও আবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, বেশ মজাই পাইতেছি। চলতে চলতে এক সময় আপন মনে গিয়ে উঠি পিচঢালা ওই পথটাকে ভালবেসেছি/তার সাথে এই মনটাকে বেঁধে ফেলেছি। দূর থেকেই দেখা গেল জটলা- বুঝতে বাকি রইল না যে এসে গেছি দীঘির কাছাকাছি। দীঘির প্রবেশ দ্বারের সাইন বোর্ডে লেখা শেরেবাংলা একে ফজলুল গেট। শ্যাওলা জমে এমন অবস্থা হয়েছে যে পড়তে বেশ কষ্ট হয়। এমন এক কীর্তিমান মহা পুরুষের নামের সাইন বোর্ডের এমন বেহাল দশা দেখে বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। যেন দেখার কেউ নেই। অথচ দীঘিটাকে পুঁজি করে মেলার নামে টাকা কামানোর ফন্দি ফিকিরের নেই কোন কমতি। দীর্ঘশ্বাস নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। প্রচ- ভিড়ের কারণে পরিবারের সদস্যদের গেটের বাইরে নামাজ ঘরে বসিয়ে আমি আর ভগ্নিপতি দুর্গাসাগর দীঘির কম্পাউন্ডে ঢুকি। প্রথম দেখায় মন জুড়িয়ে যায়, শান বাঁধানো ঘাট, দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত সবুজের খেলা, স্বচ্ছ টলটলে পানি। তৎকালীন রাজা শিব নারায়ণ দক্ষিণ বঙ্গের বৃহত্তম এই দীঘিটি খনন করান। তার স্ত্রী দুর্গা দেবীর নামে দীঘির নাম রাখেন দুর্গাসাগর। দীঘিটির মাঝখানে ষাট শতাংশ জমির ওপর দ্বীপ রয়েছে, যা কিনা দূর থেকে আসা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। দুঃখের বিষয় সেখানে যাওয়ার জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। তথ্যসূত্রে জানা যায়, দীঘিটি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে খনন করা হয়েছিল। তার স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালবাসার প্রমাণস্বরূপ তৎকালীন সময়ে রাজকোষ হতে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে দীঘিটি খনন করেছিলেন। আবার কারও কারও মতে প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য এই দুর্গাসাগর খনন করেছিলেন। তবে যাই হোক সে দিনের খনন করা দুর্গাসাগর- আজকের ভ্রমণপিপাসুদের জন্য দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে অন্যতম পছন্দের জায়গা। স্থানীয় পর্যটকদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে মানুষ ঘুরতে আসে দুর্গাসাগরের সৌন্দর্য দেখতে। এবার যাই উজিরপুরের গুঠিয়া মসজিদ। এখানেও উপচেপড়া ভিড়। পাহাড় জঙ্গলের নিরিবিলিতে ঘুরে বেড়ানো মানুষ আমিÑ তাই হয়ত এসব জায়গায় ভিড়ের মাত্রাটা একটু বেশিই লাগছে। অতিমাত্রায় ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় এড়িয়ে মসজিদের সামনে যেতেই চোখ ছানাবড়া, সু-উচ্চ মিনার দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলী, আকর্ষণীয় কারুকার্য ঘাটলা বাঁধা পুকুর, কয়েক একর জমির ওপর গড়া মসজিদটি দেখলে যে কেউ বিমোহিত না হয়ে পারবেন না, এস শরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু নামে ভদ্রলোক ২০০৩ সালে ১৬ ডিসেম্বর মসজিদ ও ঈদগাহ্ কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। দীর্ঘ তিন বছর উনার তত্ত্বাবধানে ১৪ একর জমির ওপর প্রায় বিশ হাজার মুসল্লি ধারণক্ষমতার মসজিদ ও ঈদগাহ্ কমপ্লেক্স এবং আরও কিছু স্থাপনাসহ ২০০৬ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। মসজিদের মূল নাম বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ঈদগাহ্ কমপ্লেক্স, তবে এলাকার নামকরণের সঙ্গে গুঠিয়া মসজিদ নামেই এখন দেশ-বিদেশে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। এর মিনারের উচ্চতা ১৯৩ ফুট। যার শিরঃ উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য অনেক দূর হতেই দেখা যায়। ঘুরতে ঘুরতে সূর্যাস্ত তাই আমরা মাগরিবের নামাজ আদায়ের জন্য অপেক্ষা করি, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই মসজিদ কমপ্লেক্সে রূপের পসরাও যেন জেকে বসে-পুরো মসজিদ আলোয় আলোকিত করা হয়, মসজিদ কমপাউন্ডে তখন অন্যরকম এক আবহ সৃষ্টি হয়। সু-মিষ্ট কণ্ঠের ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে মনের মাঝে বেশ তৃপ্তি অনুভব করি। বর্তমানে মসজিদটি মুসলমানদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাশাপাশি সর্ব ধর্মের মানুষের জন্যও অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এবার ফেরার পালা, পরের দিন ঘুরে বেড়াই বরিশাল শহর। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পথ-ঘাট, যানজটের ভয়াবহ চিত্র নেইÑ এক কথায় বসবাসের জন্য আসাধরণ শহর। এই জন্যই হয়ত কবি ‘আবার আসিব ফিরে’ কালজয়ী কবিতাটি লিখেছিলেন। বিকেলটা কাটাই কীর্তনখোলা নদীর তীরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ পার্কে, সন্ধ্যায় প্লানেট পার্ক, রাতে ৯টা পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন পার্কে। সঙ্গের শিশুরা পার্কের রাইডে চড়ে বেশ আনন্দ উপভোগ করে। রাত দশটার মধ্যে ঘরে ফিরি। পরদিন সকাল ৮টার ওয়াটার বাসে মনে গেঁথে থাকার মতো আনন্দময় স্মৃতি নিয়ে ঢাকায় ফিরি। তাহলে বন্ধুরা আর দেরি কেন? ঘুরে আসুন ধান-নদী-খাল এই তিনে মিলে গড়া ছবির মতো সুন্দর জেলা বরিশাল থেকে। যাতায়াত : ঢাকার সদরঘাট হতে প্রতিদিন রাতে বেশ কয়েকটা সাধারণ মানেরসহ বিলাসবহুল লঞ্চ ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশে, এছাড়া সকালে ও দুপুরে লালকুঠি ঘাট হতে ওয়াটার বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ডেকে ২০০ টাকা হতে ফ্যামেলি কেবিন ৫,০০০-৬,৫০০ টাকা এবং ওয়াটার বাসে ৭০০ ও ১,০০০ টাকা। গাবতলী ও সায়েদাবাদ হতে সড়ক পথেও বরিশাল যাওয়া যাবে। এসি ও ননএসি দু-ধরনেরই পরিবহন রয়েছে। ভাড়া ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা। থাকা-খাওয়া : ছোট্ট শহর বরিশাল ভ্রমণ করতে চাইলে রাতের লঞ্চে/বাসে গিয়ে পরেরদিন সারাদিন ঘুরে আবার রাতের বাস/জাহাজে ফিরতে পারেন আর রাত কাটাতে চাইলে শহরের সদর রোড ও পার্ক বেন্স রোডে তিন তারকা মানেরসহ মোটামুটি মানের কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে এবং খাওয়ার জন্যও পাবেন বেশকিছু রেস্টুরেন্ট। সমসাময়িক আরও বেশি তথ্য জানতে ক্লিক করুন গুগল সার্চে।
×