ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহলে সুন্নাতের স্মারকলিপি

সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কওমী সনদের স্বীকৃতি আত্মঘাতী

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২১ এপ্রিল ২০১৭

সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কওমী সনদের স্বীকৃতি আত্মঘাতী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গীবাদ গেঁড়ে বসার উদ্বেগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে সুফিবাদী সুন্নি সম্প্রদায়ের সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। কোন সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বিনাশর্তে মাস্টার্স মান দেয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে আহলে সুন্নাত। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জঙ্গীবাদবিরোধী সকল আন্দোলনে পাশে থাকার অঙ্গীকার করে তারা বলেছেন, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কওমী সনদের এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এক দেশে সরকার স্বীকৃত দুটি ইসলামী শিক্ষানীতি হতে পারে না। এতে সংঘাত তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। মাদ্রাসামুখী ছাত্রদেরও আলিয়া ছেড়ে উগ্রপন্থী কওমী নেসাবে উৎসাহী করবে। এদিকে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচী শেষে দাবি আদায়ে মাসব্যাপী শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। ‘অযৌক্তিক কওমী সনদ বাতিল করে এক নীতির মাদ্রাসা শিক্ষা নিশ্চিতের দাবি’ আদায়ে তারা আজ শুক্রবার থেকে আগামী ২০ মে পর্যন্ত দেশের আলিয়া মাদ্রাসা এবং দরবারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে গোলটেবিল আলোচনা ও দেশব্যাপী নিয়মিত প্রতিবাদ সভা আয়োজন করা হবে। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ২১ মে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা নিয়ে মাঠে নামবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। সুফিবাদী সুন্নি সাধারণের পক্ষে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক এম এ মতিন ও সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় দেশনেত্রী’ অভিহিত করে বলেছেন, আমরা এ দেশের সুফি ঘরানার সুন্নি জনতার প্রতিনিধিত্বকারী অরাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক সংগঠন ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত সমন্বয় কমিটি’ সবসময় আপনার চলমান সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী পদক্ষেপের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি, যা আপনার জানা আছে। এ অতীব জরুরী ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপের জন্য দেশের নিরীহ সুন্নি জনতা আপনার পাশে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে গত ১১ এপ্রিল আপনি জঙ্গীবাদের প্রকাশ্য সংগঠন ও এর প্রধান সংগঠক হেফাজত নেতা আহমদ শফী সাহেবের দলবলকে ডেকে নিয়ে, তাদের দাবিকে শর্তহীনভাবে মেনে নিয়ে কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের (আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ) সমমান ঘোষণা করেছেন এবং দ্রুততার সঙ্গে প্রজ্ঞাপনও জারি করে দিয়েছেন। যা দেশের সুন্নি জনতাকে শুধু নয়, বরং সকল বিবেকবান সচেতন শিক্ষিত মানুষকে, এমনকি আপনার দল ও জোটের বুদ্ধিজীবী নির্বিশেষে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। আমরা এমন ঘোষণার প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এর কারণগুলোর কয়েকটি আজ তুলে ধরছি। আহলে সুন্নাত প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের প্রস্তাব তুলে ধরে বলেছে, বর্তমান ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত সরকারীভাবেই মুসলমানদের এবং ইসলামী শিক্ষাকে বিভক্ত করার শামিল। তাই দেশে এক নীতি ও কারিকুলামের মাদ্রাসা শিক্ষা প্রণয়ন করে আলিয়া-কওমীদের একই সরকারী সনদ প্রদান করা হোক। সুন্নি এবং কওমীদের দশজন দশজন প্রতিনিধিদের ঐকমত্যে যদি কিতাবপত্র ও সিলেবাস তৈরি করে সরকারীভাবে যদি উক্ত সিলেবাসের আলোকে একই প্রশ্নপত্রের উপর একটি সরকারী বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষা নেয়া হয়। তবে সেক্ষেত্রে অর্জিত সনদ সকল বিতর্কের উর্ধে হবে। যা দেশে বিদ্যমান দুই ধারার মাদ্রাসা শিক্ষার অপমৃত্যু ঘটাবে বিধায় ওহাবী-সুন্নি বিতর্কের শত বছরের কলঙ্কজনক অধ্যায়কেও অনেকটা মুছে ফেলতে পারবে। যা দেশ ও মুসলিম জাতির জন্য একটি নতুন সুসংবাদ হবে বলে আমরা মনে করি। আর এ ঐতিহাসিক অবদানের জন্য আপনিও হাজার বছর প্রশংসিত হবেন সবার কাছে। এমনকি সমগ্র বিশ্বের মুসলমানের কাছে। তারা আরও বলেছেন, দেশে অপরাপর মাস্টার্স সনদ দেয় এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি কুষ্টিয়া, আরবী বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। অথচ, এখানে একই সনদ দেবেন হেফাজত নেতাদের একটি কমিটি, যাদের নিজেদেরও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নেই। এটা উগ্রগোষ্ঠীকে অভাবনীয় পুরস্কৃত করতে গিয়ে দেশের অপরাপর সকল মাস্টার্স সনদধারীদের অপমান করা নয় কি? সাধারণ ও আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, স্নতক বা সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে হয়। যার জন্য ব্যয় হয় ১৭-২০ বছর। অথচ তারা এতগুলো পরীক্ষা না দিয়ে মাত্র কয়েক বছরে মাস্টার্স সনদ লাভ করবে। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তো আছেই। এমনকি বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় শিক্ষকতার জন্যও তাদের নতুন করে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রয়োজন হয়। এরপরও দিতে হয় নিয়োগ পরীক্ষা, যেখানে থাকে সরকারী প্রতিনিধি। অথচ এমন কোন ঘাট পাড়ি দিতে হবে না কওমীদের। তাহলে শিক্ষকদের মান যাচাইও হবে না এখানে? এত বড় বৈষম্যমূলক আচরণ কেন সরকারীদের উপর? আহলে সুন্নাতের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, হেফাজত নেতারা বারবার ফলাও করে প্রচার করে যাচ্ছে তারা সরকারের কোন টাকা নেয় না এবং নিবে না। কিন্তু সরকারী মাদ্রাসার চেয়েও এদের অবকাঠামোগত অবস্থান অনেক বেশি বিশাল এবং তা দেখতে না দেখতেই হয়ে যায়। কিন্তু কীভাবে? এর নেপথ্যে অর্থের উৎস কী? শুধুই স্থানীয় জনগণ। না, বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ উৎসের নিরপেক্ষ তদন্ত করা হলে, যথাযথ অডিট হলে, জঙ্গীদের টাকার উৎসও বেরিয়ে আসবে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এ বিষয়টিও অধরা থেকে যাবে। আহলে সুন্নাতের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে বিস্তারিত অবস্থান ও প্রস্তাব তুলে ধরার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে স্মারকিলিপিতে। নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আমাদের এই বিষয়ে আরও অনেক বক্তব্য রয়েছে, যা প্রয়োজনে আপনার কাছে প্রত্যক্ষভাবে পেশ করতে চাইÑ যদি সে সুযোগ দেয়া হয়। আপনার এ সিদ্ধান্তে আমরা আলিয়া মাদ্রাসার ভবিষ্যত অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। সরকারীভাবে পরিচালিত আলিয়া মাদ্রাসমূহকে সাধারণ শিক্ষার পর্যায়ে নিয়ে আসছে এমনভাবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ঐতিহ্যবাহী আলিয়া কারিকুলামের মাদ্রাসা থেকে কোন যোগ্য আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির আর উঠে না আসে। আর, পক্ষান্তরে এতদিনের বেসরকারী কওমী মাদ্রাসাকে কোন ধরনের সংস্কার না করে সরকারী সনদ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মূলত মাদ্রাসামুখী ছাত্রদের আলিয়া ছেড়ে উগ্রপন্থী কওমী নেসাবে উৎসাহী করবে। সহজে ডিগ্রী পাবার আশায় এখন আলিয়ামুখী ছাত্রছাত্রীরা এখন কওমীর দিকে ঝুঁকে পড়া অস্বাভাবিক নয়। ফলে ক্রমে আলিয়া মাদ্রাসা ধ্বংস হবে এবং কওমীদের উগ্রশক্তি বৃদ্ধি পাবে। যা দেশে সুফিবাদী উদার ইসলামের পরিবর্তে উগ্রপন্থীদের উৎসাহিত করবে বিধায় আপনার ঘোষণা স্থগিত রেখে আলোচনা-একাডেমিক পর্যালোচনার পর কথিত সনদ প্রদান করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
×