ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সাহসী দৃষ্টান্ত

শারমিন আর ঘাসফুলের কিশোরীরা আশার আলো দেখাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২১ এপ্রিল ২০১৭

শারমিন আর ঘাসফুলের কিশোরীরা আশার আলো দেখাচ্ছে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার তুলনামূলক বেশি হলেও বাংলাদেশে গত দুই দশকে বাল্যবিয়ের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসঙ্গে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বেশকিছু ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে অনেক কিশোরী নিজের বাল্যবিয়ে নিজে বন্ধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কিছু ঘটনা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। বাল্যবিয়ের কুফল আজকে দেশের আনাচে-কানাচের লোকজন জানছে। সেইসঙ্গে দেশের কিশোরীরা সাহস দেখাচ্ছে বলেই বাল্যবিয়ের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে মোট ৪০টি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭। এই আইনের বিশেষ বিধানের কারণে বাল্যবিয়ে বাড়বে বৈ কমবে না বলে সমাজে আশঙ্কা বিরাজ করছে। ঠিক এ সময় কিশোরীদের বাল্যবিবাহ বন্ধের ঘটনা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে ও আশার আলো দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন নারী নেত্রী ও বিশেষজ্ঞরা। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক আইএফপিআরআইয়ের ২০১৬ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাল্যবিয়ের হার শতকরা ৬২ দশমিক ৩ ভাগ থেকে কমে ৪৩ ভাগ হয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৫ সালে বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ছিল শতকরা ১৫ দশমিক ৯ ভাগ, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের বিয়ের হার ছিল ৪৬ দশমিক ৫ ভাগ। সব মিলিয়ে বাল্যবিয়ের হার ছিল শতকরা ৬২ দশমিক ৩ ভাগ। আর ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার শতকরা ৫ দশমিক ৪ ভাগ, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের বিয়ের হার ৩৭ দশমিক ৮ ভাগ। মূলত সচেতনতার অভাবে বাল্যবিয়ের প্রকোপ আমাদের দেশে এত বেশি। সেইসঙ্গে দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতার বোধের কারণে অনেক দরিদ্র মা-বাবা কিশোরী মেয়ের ভরণপোষণ, লেখাপড়া ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার থেকে মুক্ত হতে দ্রুত বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে চান। বাল্যবিয়ে নামের ব্যাধি সমাজের গভীরে বাসা বেঁধে আছে। তা ছাড়া, আইনকানুন ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্বলতা অনস্বীকার্য, পারিবারিক বাধা তো রয়েছেই। তবে সম্প্রতি কিশোরীদের সাহসিকতা কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে। কয়েকটি ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, কিশোরী মেয়েরাই নিজেদের কিংবা তাদের সাথীদের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করছে। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার মেয়ে শারমিন আক্তার। ২০১৫ সালে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দেশব্যাপী আলোচনায় আসে। তার এই সাহসিকতার জন্য স্বর্ণকিশোরী ফাউন্ডেশন তাকে ২০১৫ সালে পুরস্কার প্রদান করে। এরপর শারমিন বাল্যবিবাহ রুখতে এবং জোরপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের এই সাহসী কন্যা সম্প্রতি বিশ্বসেরা সাহসী নারীর পুরস্কার অর্জন করেছে। ২৯ মার্চ শারমিনকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া ‘সেক্রেটারি অব স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডব্লিউওসি) ২০১৭’ পুরস্কার প্রদান করেন আমেরিকার ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। সেদিন শারমিন সাহস দেখিয়েছিল বলেই আজ সে সবার চোখে আলোকবর্তিকা হিসেবে দৃষ্টান্ত রেখেছে। সম্প্রতি আরও একটি ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। গত ৮ এপ্রিল ত্রিশাল উজানপাড়ার এক মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী সোনিয়া আক্তার তার এক শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে নিজের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছে। তার বাবা যখন তার বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিলেন, তখন সে বুদ্ধি খাটিয়ে ওই শিক্ষককে ফোন করে, শিক্ষক ফোন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে। তিনি সোনিয়ার বিয়ে ভেঙ্গে দেন এবং পুরস্কার হিসেবে সোনিয়াকে দুটি জামাও কিনে দেন। এছাড়া, ময়মনসিংহের নান্দাইলের একটি বিদ্যালয়ের সাত ছাত্রী মিলে ঘাসফুল নামে যে সংগঠন করে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের আন্দোলনে নেমেছে, তা সম্প্রতি দেশজুড়ে দারুণ সাড়া জাগিয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই তিনটি বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছে। এ জন্য তারা আইন-আদালতের আশ্রয় নিতে যায়নি। প্রথমে তারা চেষ্টা করেছে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিতে ইচ্ছুক অভিভাবকদের বোঝাতে যে বাল্যবিয়ে শুধু বেআইনী কাজই নয়, এর ফলে মেয়েদের জীবন নষ্ট হয়। কিন্তু অভিভাবকেরা যখন তাদের কথায় গুরুত্ব দেননি, তখন এই মেয়েরা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পুরো ঘটনা জানিয়েছে, প্রধান শিক্ষক মেয়েদের পরামর্শ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদনপত্র লিখতে। মেয়েরা আবেদনপত্র জমা দিলে প্রশাসন বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। ঘাসফুলের মতো সংগঠন দেশের প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠলে এবং দেশের সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বিদ্যালয়-মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকেরা বাল্যবিয়ে বন্ধ করার কাজে তৎপর হলে বাংলাদেশে আর বেশি দিন এই অভিশাপ থাকবে না। এছাড়া টাঙ্গাইল ও নীলফামারীতে সম্প্রতি দুটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন দুই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে এভাবে এগিয়ে আসা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর ইতিবাচক প্রভাব সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। বাল্যবিয়ে বন্ধে কিশোরীদের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনের ঘটনায় আশাবাদী নারী নেত্রী এবং মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট এলিনা খান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা বেড়েছে আর সে কারণেই বাল্যবিবাহের হার কমতে শুরু করেছে। তার মানে এটা নয় যে বাল্যবিয়ে হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও অধিকাংশ অভিভাবকাই তাদের কন্যাদের জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। এমন অনেক ঘটনা কিন্তু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। শারমিন কিংবা ঘাসফুলের সাত মেয়ের সাহস দেখাচ্ছে বলেই তারা নজির সৃষ্টি করছে। এটাই দরকার। নারীদের নিজেদের সমস্যা সমাধানে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করে যেসব কিশোরী আলোচিত হচ্ছে তাদের দেখে অনেকেই উৎসাহিত হবে ভবিষ্যতে বাল্যবিয়ে রুখতে। এটি দেশের উন্নয়নে অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক।’ বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে এসব প্রতিরোধমূলক ঘটনার সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। উল্টো চিত্র অর্থাৎ বাল্যবিয়ের চিত্র দেশের আনাচে কানাচে এখনও অপরিবর্তিত। সব খবর সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে না পেরে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে এক কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনা দেশবাসীকে স্তব্ধ করেছে। এছাড়া, চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জীবন দিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে গাইবান্ধার সাঘাটার মনীষা। কলেজছাত্রী মনীষা বেগম বিয়ের বিরুদ্ধে নিজের শরীরে আগুন দেয়। অগ্নিদগ্ধ মনীষা তিনদিন বিনা চিকিৎসায় থেকে মারা যায়। সে বোনারপাড়া বালিকা বিদ্যালয় এ্যান্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল। বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ অভিভাবকদের মানসিকতা। অভিভাবকরা যতদিন বুঝবেন না যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে তার বিরাট ক্ষতিসাধন করা হয়, ততদিন বাল্যবিয়ে বন্ধ করা কঠিন। তাই পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তবে শারমিন কিংবা ঘাসফুল সংগঠনের সাত কিশোরীর মতো বাকিরাও বাল্যবিয়ে বন্ধে স্ব স্ব সাহসিকতার পরিচয় দিতে থাকেল তাহলে অভিভাবকেরাও আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবেন না। আর এজন্য বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন ও বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচার জরুরী। তাহলেই প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুসারে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে মেয়েদের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সব ধরনের বাল্যবিয়ে বন্ধের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয় বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের ৪০০ উপজেলায় ৪০০ কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে। এ ছাড়া অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সারাদেশে আরও তিন হাজার এ রকম ক্লাব আছে। এসব ক্লাবে বাল্যবিয়ের খারাপ দিক নিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করা হয়। এ ছাড়া স্কুল বা কলেজ থেকে ঝরে পড়া প্রায় ১০ হাজার কিশোরীকে বৃত্তিমূলক কাজের জন্য আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে। শিশুদের জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চলছে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর আওতায় ও প্রচার চালানো হচ্ছে।
×