ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্য নির্ধারণ করে দেবে বিশেষজ্ঞ কমিটি

হার্টের রিং বাণিজ্যের দিন শেষ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২১ এপ্রিল ২০১৭

হার্টের রিং বাণিজ্যের দিন শেষ

নিখিল মানখিন ॥ লাগাম টেনে ধরায় হাসপাতালগুলোতে রিং সরবরাহে গড়িমসি করছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর প্রতিনিধিদের এমন কাজের সঙ্গে হাসপাতালগুলোর অনেক চিকিৎসক ও কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে হার্টের রিং নিয়ে নৈরাজ্য চালাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। রিংয়ের দাম ও রিং বসানো নিয়ে দেশে বহু মুখরোচক ঘটনা ঘটেছে। রোগীদের কাছ থেকে উচ্চমূল্য নিয়ে নিম্নমানের রিং বসানোর অনেক ঘটনাও বেশ আলোচিত হয়েছে। আবার দুই থেকে তিনটি রং বসানোর কথা বলে ১টি রিং বসিয়ে রোগীদের কাছ থেকে টাকা আত্মসাতের কাহিনীও বিভিন্ন সময় খবরের কাগজে এসেছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে হার্টের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ ও মোড়কে নির্ধারিত মূল্য লিখে রাখার বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিফতর সিদ্ধান্ত নেয়। আর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের মতো করে গড়ে তোলা একচেটিয়া ব্যবসায় এমন সরকারী সিদ্ধান্ত আঘাত হানে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রস্তাবিত দামে নয়, আগের দামেই রিং সরবরাহ করা যাবেÑ এমন আশ্বাসের পর বৃহস্পতিবার ধর্মঘট তুলে নেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা। তবে একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একই পণ্য দেশের যে কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে অভিন্ন দামে সরবরাহ করা হবে। এর আগে একটি প্রতিষ্ঠানের একই পণ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ভেদে বিভিন্ন দামে সরবরাহ করা হতো। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কার্ডিয়াক বা হার্টের রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় করোনারি স্টেন্ট বা রিংয়ের মূল্য সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে জাতীয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এখন পর্যন্ত অধিদফতরের কাছে মাল্টিলাইন ভ্যাক্সিন, রেবিল, প্রিমিয়ার এলিমেন্ট ও ওরিয়েন্ট এক্সপোর্ট নামে ৪টি প্রতিষ্ঠান তাদের করোনারি স্টেন্টের মূল্য প্রস্তাব করেছে। যেখানে নন মেডিকেটেড স্টেন্টের সর্বনিম্ন মূল্য ২৫ হাজার টাকা ও মেডিকেটেড স্টেন্টের মূল্য দেয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। আরও যে ১৮টি কোম্পানি ৪৭ ধরনের স্টেন্ট আনে, তারা এখনও কোন মূল্য প্রস্তাব করেনি। ভারতে একটি স্টেন্টের মূল্য ৭ হাজার ২ রুপী, যা বাংলাদেশী অর্থে ৮ হাজার ৯০০ টাকা হয়। এসব স্টেন্ট ভারতে উৎপাদন করা হয়। আর বাংলাদেশে পুরোটাই আমদানিনির্ভর। অভিযোগ রয়েছে, দেশের কয়েকটি হাসপাতালে ১৮ হাজার টাকার হার্টের রিং দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে। কিছু অসাধু চিকিৎসকের কমিশন বাণিজ্যের কারণেই রোগীদের কাছ থেকে এ বাড়তি মূল্য নেয়া হচ্ছে। ফলে রিংয়ের মূল দামের চেয়ে ৮ থেকে ১৭ গুণ বেশি দিতে হচ্ছে গ্রাহককে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে ২২টি কোম্পানির স্টেন্টসহ ৪৭ প্রকারের মেডিক্যাল ডিভাইসের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। রেজিস্ট্রেশনভুক্ত কোম্পানিগুলোকে এখন থেকে দাম, রেজিস্ট্রেশন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ করতে হবে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অঘোষিত ধর্মঘটের কারণে বুধবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ সারাদেশে সরকারী হাসপাতালে হার্টের রিং পরানো কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। বুধবার সারাদিন সরকারী হাসপাতালে রিং সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইসেস ইম্পোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গাজী শাহীন বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে জানান, রিং সরবরাহে কোন ধরনের ধর্মঘট ডাকা হয়নি। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রস্তাবিত মূল্য নির্ধারণের প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে কিছু সময়ের জন্য রিং সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল। রিং আমদানি করার ক্ষেত্রে বহুমুখী ব্যয়ের দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, হার্টের রিংয়ের বিষয়টি মানুষের জীবন মরণের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে আমরা কখনও অনৈতিক ব্যবসা করতে পারি না। রঙের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। রিং আমদানি স্বল্প সময়ে শুরু হয়নি। এটা বাংলাদেশে আনার জন্য নিরাপদ ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়েছে। অনেক রিং মেয়াদোত্তীর্ণ ও নষ্ট হয়ে যায়। বসানোর আগে একটি রিংয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও রোগীর জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে অতিরিক্ত রিং বসিয়ে দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ওই অতিরিক্ত রিংয়ের টাকা অধিকাংশ রোগীর স্বজনেরা দিতে চান না। এছাড়া রয়েছে আমদানি করার প্রসেসিং ও রিংগুলোর গুণ ঠিক রাখার জন্য বিবিধ ব্যয়। এভাবে শুধু বিদেশের মূল্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মূল্য নির্ধারণ করা হলে চলবে না। এসব কিছুর পর ব্যবসায়ীদের কিছু লাভের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। বুধবার রিং সরবরাহ বন্ধ রাখার পর পুনরায় চালু করার বিষয়ে গাজী শাহীন বলেন, চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারিত হওয়ার পর বিষয়সমূহ আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। একটি আমদানিকারক কোম্পানি আপাতত দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ‘এমআরপি’ মূল্যে রিং সরবরাহ করবে। অর্থাৎ একটি ইউনিফর্ম মূল্য তৈরি করা হয়েছে। একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একই পণ্য দেশের যে কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে অভিন্ন দামে সরবরাহ করা হবে। এর আগে একটি প্রতিষ্ঠানের একই পণ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ভেদে বিভিন্ন দামে সরবরাহ করা হতো। এই শর্তেই রিং সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে বলে জানান গাজী শাহীন। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান এ ধরনের অঘোষিত ধর্মঘটকে দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হার্টের রিং নিয়ে আর কাউকে বাণিজ্য করতে দেয়া হবে না। ১৭ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। সবাইকে ওই মূল্যেই রিং বিক্রি করতে হবে। এ বিষয়ে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আফজালুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বুধবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রিং সরবরাহ বন্ধ রাখলেও জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে রিং বসানো কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। তবে বুধবার বিকেলে ফোন করে রিং সরবরাহ করার কথা জানান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই হাসপাতালে পাঁচটি ক্যাথ ল্যাবের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি রিং পরানো হয়।
×