ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

‘প্রতিবছর করের হার পরিবর্তন কাম্য নয়, দরকার ৫ বছরী ব্যবস্থা’

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২১ এপ্রিল ২০১৭

‘প্রতিবছর করের হার পরিবর্তন কাম্য নয়, দরকার ৫ বছরী ব্যবস্থা’

এখন বাজেটের মৌসুম। আগামী জুন মাসে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপিত হবে। ওই মাসেই পাস এবং জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে। এতদ-উপলক্ষে অন্যান্য বছরের মতোই সর্বত্র বাজেট নিয়ে আলোচনা। সরকারী কর্মকর্তারা ব্যস্ত বাজেট প্রণয়নে। ব্যবসায়ী এবং এক শ্রেণীর উৎসাহী লোক বাজেটের ওপর সুপারিশ করে যাচ্ছেন। আবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং নেতাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন সরকারের সঙ্গে বাজেট নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। সরকারের এজেন্সিগুলো ব্যবসায়ীদের পেটের কথা জেনে নিয়ে ঠিক উল্টোটি করেন। এই অভিযোগ কতটুকু সত্য তা আমি জানি না। সত্য-মিথ্যা যাই হোক দেখা যায় মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে বাজেটের ওপর আলোচনার একটা ‘ধুম’ ওঠে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এতে ‘বাতাস’ দেয়। এই ‘বাতাসের’ আমিও শিকার। অনেকদিন যাবত প্রতিবছর বাজেটের ওপর লিখে যাচ্ছি। ‘নতিজা’ কী হবে এ সম্পর্কে ভাবি কম। আমার কাজ আমি করি, বাকিটা ভবিতব্যের। এ প্রেক্ষাপটেই আজকের নিবন্ধে আগামী বছরের বাজেটের ওপর কিছু আলোকপাত করব। আর এই আলোচনার কেন্দ্র ব্যবসায়ী এবং কিছু গবেষকের সুপারিশ। একটি কাগজে দেখলাম ‘ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সরকারের কাছে কতগুলো দাবি করেছে। তাদের প্রথম দাবি কর কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদী হওয়া দরকার। অন্তত পাঁচ বছরের জন্য। এটি প্রতিবছর পরিবর্তন করা উচিত নয়। দ্বিতীয় দাবি কর্পোরেট কর ১০ শতাংশ কমাতে হবে। তৃতীয় দাবিটি করমুক্ত আয়সীমার ওপর। করমুক্ত আয়সীমা হওয়া দরকার কমপক্ষে ৪ লাখ টাকা, বর্তমানের আড়াই লাখ টাকার পরিবর্তে। আগামী অর্থবছর থেকে ১৫ শতাংশ হারে যে ‘ভ্যাট’ চালু করার কথা তার হার হওয়া উচিত ৫ শতাংশ। আয়করের ক্ষেত্রে বিনিয়োগসীমা পূর্বতন হার অর্থাৎ ৩০ শতাংশ পুনর্বহাল করা উচিত। এটি তাদের আরেকটি অন্যতম দাবি। এদিকে একটি গবেষণা সংস্থা তার অনেক সুপারিশের মধ্যে একটিতে বলেছে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম কমাতে। বলেছে টাকার বিনিময় মূল্য (এক্সচেঞ্জ রেট) হ্রাস করতে অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়ন (ডিভ্যালু) করতে। আরেকটি দাবি তাদের : ‘প্রাইস কমিশন’ গঠন করা হোক। অনেক দাবির মধ্যে কয়েকটি ওপরে তুলে ধরলাম। একটি দাবি আমি পুরোপুরি সমর্থন করি। সেটি হচ্ছে প্রতিবছর ‘করকার্যক্রম’ (ট্যাক্স স্টেপস) পরিবর্তন না করার দাবি। বর্তমানে প্রতিবছর সমস্ত করের হার পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা এদিক-সেদিক করা হয়। অনেক সময় এসবের কোন যুক্তি পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা এটা সরকারের সুবিধার দিক, এতে করদাতাদের বিষয়টা বিবেচিত নয়। কোম্পানি কিংবা পার্টনারশিপ ব্যবসা কিংবা একজন ব্যক্তি যদি জানে যে, এই হচ্ছে করের হার, করের সুবিধা-অসুবিধা এবং তা আগামী পাঁচ বছর চালু থাকবে তাহলে তারা কর পরিকল্পনা করতে পারে, বিনিয়োগের পরিকল্পনা করতে পারে। বর্তমানে বাজেটে যে সুযোগ দেয়া হয় তা জানতেই বছর চলে যায়। অনেক সময় কর কর্মকর্তারাও তা বলতে পারেন না। অতএব ‘কর প্রস্তাব’ দীর্ঘমেয়াদী হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। কর্পোরেট করের হার হ্রাসের যে প্রস্তাব এসেছে তা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। তবে যে দাবিটি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার সেটি হচ্ছে করমুক্ত আয়। বর্তমানে তা আড়াই লাখ টাকা অর্থাৎ মাসে কুড়ি হাজার টাকা মাত্র। ভাবা যায়! একজন দৈনিক ছয়-সাতশত টাকা আয় করলেই তাকে কর দিতে হবে। তাহলে তো একজন রিক্সাওয়ালাও করযোগ্য হয়। তাই নয় কী? এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে এটা অযৌক্তিক বলেই বিবেচিত যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে করমুক্ত আয় হচ্ছে বাংলাদেশী টাকায় আট লাখ টাকা। যুক্তরাজ্যে তা আরও বেশি। প্রতিবেশী ভারতেও আমাদের তুলনায় বেশি। তারপরও কথা আছে। আয়ের ওপর বিনিয়োগ বেয়াত আছে। এটা আগে ছিল ৩০ শতাংশ। তা হ্রাস করে করা হয়েছে ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা আয় হলে একজন করদাতা ২৫ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারেন এবং তা করলে তিনি রেয়াত পান। এখন শুধু ৩০ থেকে ২৫ শতাংশে হ্রাস করেই ক্ষান্ত হয়নি সরকার, রেয়াত হিসাবের ক্ষেত্রে করা হয়েছে নানা জটিলতা, যা হিসাব করতেই করদাতাদের ‘জান’ বেরিয়ে যায়। প্রশ্ন: এসব জটিলতায় সরকারের লাভ কতটুকু তার হিসাব কী করা হয়েছে? আমি নিশ্চিত নই। দেখা যাচ্ছে আয়কর ক্ষেত্রে এমন অবস্থা করা হয়েছে যাতে কর বাড়ে এবং করদাতার ‘টেকহোম পে’ হ্রাস পায়। এর ফলে কী ভাল? ভোগের (কমজামশন) কী হবে? ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার নেতারা পরিষ্কার বলেছেনÑ এ বছর ভোগের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। যদি মানুষের আয় হ্রাস করানো হয় তাহলে ‘ভোগ’ বাড়বে কোত্থেকে? ‘ভোগ’ না বাড়লে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে কীভাবে? এমতাবস্থায় আশা করি সরকার করমুক্ত আয়সীমা যৌক্তিকভাবে বাড়াবে। ‘ভ্যালু এ্যাডেড ট্যাক্সের’ হার যদি সকল ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হয় তাহলে নির্বাচনের আগে তা ‘অশান্তি’ বাড়াবে বলে মনে করি। এই ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলে গ্যাস, বিদ্যুত থেকে শুরু করে সকল পণ্যের দাম বাড়বে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার পরিণতি কী তা সরকার ভাল করেই জানে। এমতাবস্থায় ‘ভ্যাট’ প্রয়োগ ক্ষেত্রে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এর হার নির্ধারণ করা উচিত। মনে রাখা উচিত সরকার কিন্তু ধীরে ধীরে ‘এক্সপেন্ডিচার ট্যাক্সের’ দিকে যাচ্ছে। আর ওদিকে আছে ‘উৎসে কর কর্তন’। যদি তাই হয় তাহলে ‘ইনকাম ট্যাক্সের’ প্রয়োজন কী? মানুষকে আয় করতে দিন। জায়গায় জায়গায় ‘হেভি ট্যাক্স’ করে তার কাছ থেকে খরচের সময় কর আদায় করে নেয়া হোক। তাছাড়া তো এটা অবিচার বলেই মনে হয়। এবার আসা যাক ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য হ্রাসের প্রশ্নে। এটি সমর্থনযোগ্য। এ দুটো বহুল ব্যবহৃত পণ্য। এদের মূল্য হ্রাস করলে অর্থনীতি উপকৃত হবে বলেই মনে হয়। তবে একটা দাবি সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। আর সেটি হচ্ছে টাকার মূল্য নির্ধারণ। বহুদিন ধরে টাকার ‘এক্সচেঞ্জ ভ্যালু’ মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আছে। হঠাৎ করে নানা যুক্তিতে ‘টাকা অবমূল্যায়ন’ করা হলে তার পরিণতি হবে বিরূপ। টাকার মূল্যের সঙ্গে শুধু ‘রেমিটেন্স’ এবং রফতানির সম্পর্ক নয়, এর সঙ্গে সম্পর্ক দেশীয় শিল্পের, আমদানির, দ্রব্যমূল্যের এবং সাধারণ ক্রেতার। রফতানি বাড়াতে হবে, রফতানিকে প্রতিযোগিতামূলক করতে এসব যেমন ‘হাছা’ কথা, তেমনি দেশীয় শিল্পকে বাঁচাতে হবে, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য সহনশীল রেখে ক্রেতা-ভোক্তাদের বাঁচাতে হবে এসবও ‘হাছা’ কথা। টাকার মূল্য হ্রাস করলে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাবে তার গ্যারান্টি কী? বিদেশে আমাদের কর্মীদের কাছ থেকে ডলার কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা- এই হচ্ছে খবর। তারা ওই ডলার বিদেশে বিনিয়োগ করছে বলে জানা যাচ্ছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে ঢালাওভাবে তা টাকার মূল্যের ওপর চাপিয়ে দিলে তো লাভ হবে না। অর্থনীতি এখন স্থিতিশীল। মূল্যস্ফীতিও স্থিতিশীল। অপরিণামদর্শী কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বাজারটাকে গরম করা ঠিক হবে কি? মোদ্দাকথা, টাকার মূল্য নির্ধারণে সকল পক্ষের হিসাব করতে হবে। পক্ষগুলো হচ্ছে : সাধারণ ভোক্তা (মূল্যস্ফীতি), দেশীয় শিল্প (তার আমদানি ব্যয়), রেমিটেন্স ও রফতানি। সবাই কিন্তু ওজনদার পক্ষ। অতএব সাবধান। পরিশেষে আরেকটি দাবি সম্পর্কে দুটি কথা বলে শেষ করব। ‘প্রাইস কমিশন’। এটা করতে কোন আপত্তি দেখি না। এটা অনেক দেশেই আছে। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে অনেক অযৌক্তিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এক টাকার সয়াবিন দুই টাকায় বিক্রি, এক টাকার ওষুধ দুই টাকায় বিক্রি থেকে শুরু করে প্রায় সকল ক্ষেত্রে ‘দ্রব্যমূল্য’ যেন পাগলা ঘোড়া। এর চাপে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। কিন্তু বিকল্পহীন মানুষ সব হজম করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ‘মূল্য কমিশন’ গঠনের পর যদি রোজার মাসে দ্রব্যমূল্যে লাগাম টানার ব্যবস্থা হয় তাহলে সরকার তো মানুষের দোয়া পাবে- তাই নয় কী? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×