সৈয়দা ফরিদা ইয়াসমিন জেসি ॥ বহুল আলোচিত রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাপা চেযারম্যান এরশাদসহ ৩ আসামি খালাস পেয়ে গেছেন। বিচারক রায়ে বলেছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে সরকারের ৬৪ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হলেও কে, কত টাকা আত্মসাত করেছেন, কীভাবে করেছেন তা বলা হয়নি। কোন সাক্ষীও আদালতে তা বলেননি। তাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের বেকসুর খালাস প্রদান করা হলো।
বুধবার বিকেলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লা এই রায় দেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া প্রসঙ্গে বিচারক রায়ে আরও বলেছেন, দুদকের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। খালাসপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেনÑ সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধান সুলতান মাহমুদ ও সাবেক সহকারী বিমানবাহিনীর প্রধান মমতাজ উদ্দিন আহমদ। তৃতীয় আসামি ইউনাইটেড ট্রেডার্স লিমিটেডের পরিচালক এ কে এম মুসা পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন।
রায় ঘোষণার সময় এরশাদসহ ৩ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণাকালে প্রায় আধাঘণ্টার মতো নির্বিকার ভঙ্গিতেই ছিলেন ৮৭ বছর বয়সী এরশাদ। বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তবে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করছি। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে আমরা আপীলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুস সালাম বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে আপীল করা হবে কি না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
রায় ঘোষণাকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিএম কাদের, মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম মিলন, সালাহ উদ্দিন মুক্তি, মশিউর রহমান রাঙ্গা, আবু হোসেন বাবলা, কাজী ফিরোজ রশিদসহ প্রমুখ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক আরও বলেছেন, মামলার ৩৮ সাক্ষীর মধ্যে ১২ সাক্ষী দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। মামলায় অব্যাহতি পাওয়া এক আসামি স্বীকারোক্তি গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটসহ ৪ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিল যাদের দুদক আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি। আদালতে যে সকল সাক্ষী দুদক উপস্থাপন করতে পেরেছিল তারাও ক্রয়কৃত রাডারের মান নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করেননি। বরং ক্রয়ের পর থেকে রাডার ভালভাবে সেবা দিয়ে আসছে বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাই ফ্রান্সের টমসন কোম্পানির রাডারের তুলনায় ক্রয়কৃত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টিং কোম্পানির রাডার তুলনামূলক ভাল বলেই প্রতীয়মান নয়। এছাড়া আসামি এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শুধু রাডার ক্রয়ের বিষয়টি ফরমাল অনুমোদন করেছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১৯৮০ সালে বিমানবাহিনীর জন্য একটি হাই-পাওয়ার এবং দুটি লো-লুকিং লেভেল রাডার ক্রয়ের প্রস্তাব করে। ফ্রান্সের থমসন কোম্পানি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম মূল্যে ২০ দশমিক ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে তা সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আসামিরা পরবর্তীতে পরস্পর যোগসাজশে সরকারী অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টিং কোম্পানির সঙ্গে তা ক্রয়ের জন্য ৪ কোটি ৯ লাখ ৬২ হাজার মার্কিন ডলারে চুক্তি করে। এর মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের ৬৪ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকার ক্ষতি করেন।
১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রায় তিন ডজন মামলা হয়। এর মধ্যে বহুল আলোচিত জনতা টাওয়ার মামলাসহ তিনটি মামলায় তার সাজার আদেশ হয় এবং জনতা টাওয়ার মামলায় তিনি ৫ বছর সাজাও ভোগ করেন। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনটি মামলায় তিনি খালাস পান। মামলাগুলো হলোÑ বিটিভির ইএনজি ক্যামেরা ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা, শিল্প ব্যাংকের ঋণ গ্রহণ সংক্রান্ত দুর্নীতি ও বহুল আলোচিত স্বর্ণ চোরাচালান সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা। এছাড়া এরশাদ দেশের ৮৯ উপজেলায় টেলিফোন লাইন স্থাপনে (টিএন্ডটি) দুর্নীতি মামলায় খালাস পান। এছাড়া যুক্তরাজ্যের অর্থ পাচারের অভিযোগের দায়ের করা মামলায় এরশাদ ও তার বান্ধবী মরিয়ম মমতাজ মেরীকে অব্যাহতি দেয় দুদক। পরে ২০১১ সালের ১৯ জুন আদালত তা অনুমোদন করেন।
রাডার ক্রয় মামলাটি গত ১২ এপ্রিল দুদক ও আসামিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হওয়ার পর রায় ঘোষণার জন্য ১৯ এপ্রিল দিন ধার্য করেন বিচারক। ১৯৯২ সালের ৪ মে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর দায়ের করা এ মামলায় ১৯৯৪ সালের ২৭ অক্টোবর আদালতে চার্জশীট দাখিল করে ব্যুরো। ১৯৯৫ সালের ১২ আগস্ট এরশাদসহ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মামলার সুপ্রীমকোর্টের আদেশে স্থগিত ছিল। পরে মামলার ১৮ বছর পর ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট শুরু হয় বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল চার্জশীটের ৩৮ সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওই বছর ১১ জুন তৎকালীন ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আবদুর রশিদ মামলাটির যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে পর্যায় এসে মামলাটি পরিচালনায় বিব্রতবোধ করেন। এরপর মামলাটির নথি রায় ঘোষণাকারী আদালতে আসে।
আদালতে একাধিক ধার্য তারিখে যুক্তিতর্কের শুনানির পর দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে আর কিছু সাক্ষী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়। ২০১৬ সালের ৭ নবেম্বর ওই আবেদন নাকচ করেন বিচারক। ফলে ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করে দুদক। ওই আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৬ সালের ২৪ নবেম্বর হাইকোর্ট সাক্ষ্যগ্রহণের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে বিচার শেষ করতেও নির্দেশ দেয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে আসামি সুলতান মাহমুদ আপীল বিভাগে আবেদন করেন এবং আপীল বিভাগ পুনরায় সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ বাতিল করে। এরপরই বিচারিক আদালত যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে।
এরশাদের আরেক আইনজীবী সামসুদ্দিন বাবুল বলেন, রাডার মামলায় খালাস পাওয়ায় এখন তার মক্কেলের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা বিচারাধীন থাকল। তবে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বিভিন্ন উপহারসামগ্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেয়ার মামলায় আগামী ৯ মে হাইকোর্ট আপীলের রায় ঘোষণা করবে।