ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রী বললেন, আমরা জোর করে গাড়ি নামাতে পারব না, গাড়ির সঙ্গে জড়িতরা খুবই প্রভাবশালী ;###;মালিকরা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ও স্বার্থের বিষয়ে তারা এককাট্টা

পিছু হটল সরকার ॥ সিটিং সার্ভিস চলবে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২০ এপ্রিল ২০১৭

পিছু হটল সরকার ॥ সিটিং সার্ভিস চলবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অব্যাহত চাপের মুখে পিছু হটল সরকার। টানা পাঁচদিন নগরবাসীকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়ে সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যদিও বাস নামানোর অনুমোদনের শর্তে সিটিং সার্ভিস বলতে কিছু নেই। যত আসন তত যাত্রী বিবেচনায় বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবুও বেশি লাভের আশায় পরিবহন মালিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে সিটিং সার্ভিসের নামে বছরের পর বছর প্রতারণার অভিযোগ ছিল যাত্রীদের। যার ধারাবাহিকতায় ১৫ এপ্রিল থেকে সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে। ১৬ এপ্রিল থেকে সিটিং সার্ভিস বন্ধে অভিযান শুরু করে বিআরটিএ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটিং সার্ভিসকে বৈধতা দিতেই এত নাটক। যার নেপথ্যে রয়েছে সরকার সমর্থিত পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। এর সঙ্গে যুক্ত সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ কর্মকর্তারাও। অনেকেই বলছেন, সিটিং পরিকল্পনা করেই সিটিং বাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন মালিকরা। এর পর তারাই বাস বন্ধ করেছেন। সঙ্কট তৈরি করে সিটিং সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার তুলে ধরেছে সব মহলে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী কাদের বলেন, তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযান করছেন বিষয়টি জনস্বার্থে রিভিউ করতে বলেছি। সবাইকে নিয়ে বসে জনস্বার্থে বাস্তবভিত্তিক নিয়ামক সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছি। পরিবহন খাতের প্রভাবশালীদের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায় আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যেই সিটিং সার্ভিস চলার সিদ্ধান্ত বহাল থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিআরটিএ কার্যালয়ে বৈঠক সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হচ্ছে সকাল থেকেই এমন আলোচনা ছিল পরিবহন নেতাদের মধ্যে। সূত্রে জানা গেছে, বন্ধের সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করতে গত তিন দিনে কয়েকদফা মালিক-শ্রমিকদের বৈঠকও হয়েছে রাজধানীর একাধিক স্থানে। এ নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিভক্তিও দেখা দেয়। তবে সিটিং সার্ভিসের মালিকরা এ ব্যাপারে ছিলেন এককাট্টা। তারা পরিবহন নেতাদের ওপর অব্যাহত চাপ সৃষ্টি করেন। পাশাপাশি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছেও অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে চাপ দেন। অন্যথায় কৌশলে পরিবহন ধর্মঘট করারও হুমকি দেন তারা। যার ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবারই বৈঠকের সিদ্ধান্ত দেন সড়কমন্ত্রী। বুধবার বিকেল চারটায় বিআরটিএ এলেনবাড়ি কার্যালয়ে আয়োজিত বৈঠকে মালিক-শ্রমিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিআরটিএ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মোঃ মশিয়ার রহমান জানান, সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাস মালিকদের সঙ্গে আলোচনার পর সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান স্থগিতের কথাও জানান তিনি। তিনি বলেন, আগামী ১৫ দিন সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ থাকবে। তারপর সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সময়ের মধ্যে বিআরটিএ নির্ধারিত চার্ট অনুযায়ী সব বাসের ভাড়া নিতে হবে বলে জানান বিআরটিএ চেয়ারম্যান। তা না করলে সড়কে কার্যত ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি। যাত্রীরা যদি চায়, তাহলে সিটিং সার্ভিসকে একটি আইনী কাঠামোয় আনার পরিকল্পনা নেয়া হবে বলে জানান বিআরটিএ চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, যারা অভিযানের কারণে বাস নামাননি তাদের তালিকা করা হয়েছে। আরও কাজ চলছে। প্রথমে কারণ দর্শাতে হবে, তারপর শাস্তি দেয়া হবে। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান বলেন, যদি মনে করা হয়, সিটিং সার্ভিস নামে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাত্রী চাহিদা আছে; তাহলে সেটা আইনী কাঠামোর মধ্যে এনে চালু করা যেতে পারে। বৈঠকে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, কাল থেকে আগামী ১৫ দিন পর্যন্ত সিটিং সার্ভিস বন্ধে কোন অভিযান হবে না। তবে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত চলবে। তারা অন্যান্য বিষয়ে দোষ-ত্রুটি পেলে ব্যবস্থা নেবে। তিনি জানান, রাজধানীতে বাসের রুট পারমিট অনুমোদন দেয় রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি (আরটিসি)। বর্তমানে সিটিং সার্ভিসের কোন অনুমোদন নেই। তাই এ সার্ভিস বেআইনী। এমন বাস্তবতায় আজকের বৈঠকে নগরীতে সিটিং সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা এ নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটিতে মালিক, শ্রমিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, পুলিশ, সাংবাদিক, বিআরটিএ থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের লোকজনও থাকবেন। এই কমিটি নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে সিটিং সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে রিপোর্ট দেবে। রিপোর্টের ওপর সিটিং সার্ভিসের আইনী বৈধতা নির্ভর করছে বলেও জানান তিনি। বুধবার দিনভর দুর্ভোগ এদিকে গেল পাঁচ দিনেও রাজধানীর গণপরিবহনে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরেনি। নগরজুড়ে বাস সঙ্কট অব্যাহত ছিল। সিটিং-লোকাল খেলা চলেছে বুধবার দিনভর। সেই সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ি তো আছেই। কিছু পরিবহন এখনও তাদের কাউন্টার বহাল রেখেছে। নির্দিষ্ট স্থানের স্টপেজে চেকিং আছেই। বাসে ভাড়ার তালিকা প্রদর্শনেরও খবর নেই। সিটিং সার্ভিস বন্ধের প্রতিবাদে মালিকদের অনেকেই গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন। বাসের কৃত্রিম সঙ্কটের মুখে মাসুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীর। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। বুধবারও সিটিং সার্ভিস বন্ধে মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনা করেছে বিআরটিএ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পরিবহন সেক্টরে এরকম নৈরাজ্য আর চোখে পড়েনি। যার যা ইচ্ছে করছে। সরকার হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছে না। বড় বিষয় হলো, সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এই সেক্টরে। সূত্রে জানা গেছে, দেশের পরিবহন শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা পরিবহন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি। আর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। মন্ত্রী-এমপিরা পরিবহন নেতা হওয়ায় দেশের পরিবহন খাত এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি থেকে শুরু করে সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীও পরিবহনের মালিক। খন্দকার এনায়েত উল্যাহ দাবি করেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পর প্রথম দুদিন পরিস্থিতি ‘একটু খারাপ’ থাকলেও আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু ক্রমাগত সমালোচনার কারণে মন্ত্রী গতকাল বিষয়টি ‘রিভিউ’ করতে বলেন। আমরা কাজটা ধরেছিলাম যে জিনিসটাকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসি। শৃঙ্খলা এলে দরকার হলে এই ভাড়া দিয়েই সিটিং সার্ভিস চালু করে দিতাম। কিন্তু তারপরও আমরা সমালোচনার পাত্র হচ্ছিলাম। এ কারণে তিনি রিভিউ করার কথা বলেছেন। বর্তমানে ঢাকা বাস মালিকের বেশিরভাগই সরকারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কিছু মালিক অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বাণিজ্যিক দিক থেকে সবাই এককাট্টা। এদিক বিবেচনায় মালিক সমিতি বা সরকারী যে কোন সিদ্ধান্ত শতভাগ বাস্তবায়নের কথা। মাঠের চিত্র তা নয়। সিটিং সার্ভিস রাখার পক্ষে প্রভাবশালী বেশ কয়েক পরিবহন মালিক অবস্থান নিয়েছেন। মূলত তাদের নির্দেশেই অনেক কোম্পানির বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এমন বাস্তবতায় পিছু হটল সরকার। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল শনিবার থেকে। ঘোষণা বাস্তবায়নে রবিবার থেকে মাঠে নামে বিআরটিএ। অভিযানের শুরু থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীর সঙ্গে বচসা-মারামারির ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন স্থানে। বিআরটিএর অভিযানের মধ্যে অনেক মালিক রাস্তায় বাস না নামানোয় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীকে। মিরপুর ১২ নম্বর-মতিঝিল রুটে চালু থাকা বাস সার্ভিস বিকল্প অটো, ল্যাম্পস ও হাজী পরিবহনের আগে যেখানে পাঁচ মিনিটে একটি করে বাস আসত, সেখানে এখন আধঘণ্টায়ও বাসের দেখা মিলছে না বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। এদিকে বাস সঙ্কটের কারণে রাজধানীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কমলাপুর, মুগদা, বাসাবো, খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, মধ্য বাড্ডা, প্রগতি সরণি, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর, ফার্মগেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানম-ি, সায়েল্যাব, শাহবাগ, পল্টন, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
×