ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনদের বর্ষবরণ ‘মাহা সাংগ্রাই পো ওয়ে’

বাহারি পত্র-পল্লব ফুল আর বেলুনশোভিত বর্ণিল প্যান্ডেল

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

বাহারি পত্র-পল্লব ফুল আর বেলুনশোভিত বর্ণিল প্যান্ডেল

এইচ এম এরশাদ ॥ কক্সবাজারে রাখাইন সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব সাংগ্রাইয়ের অন্যতম আকর্ষণ জলকেলি বা পানিখেলা অনুষ্ঠান সমাপ্ত হচ্ছে- আজ বুধবার। শহরের ৮টি স্পটসহ মহেশখালী, টেকনাফ, চৌধুরীপাড়া, চৌফলদন্ডীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে সোমবার থেকে ৩ দিনব্যাপী শুরু হয় এ অনুষ্ঠান। রাখাইন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকা অনুসারে ১৬ এপ্রিল শেষ হয়েছে রাখাইন বর্ষ ১৩৭৮ সাল। আর ১৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে নতুন ১৩৭৯ রাখাইন বর্ষ। জানা যায়, রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব ‘মাহা সাংগ্রাই পো-ওয়ে’ উদযাপনের মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে তারা। সাংগ্রাই উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপভোগ্য উৎসব হচ্ছে- রাখাইন কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের পানি খেলার অনুষ্ঠান (রিংলং পো-ওয়ে)। আগে থেকে তরুণ-তরুণীরা বিশেষ আকারে তৈরিকৃত প্যান্ডেলে নানা ধরনের সতেজ ফুল, বাহারি পত্র-পল্লব ও বর্ণিল বেলুন দিয়ে প্যান্ডেল শোভিত করেছে। কক্সবাজারে আকর্ষণীয় প্যান্ডেলসমূহে লাল রঙের কৃষ্ণচূড়ার ফুল ও মেয়েরা নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে একই রঙের বিভিন্ন পোশাক পরিধান করেছে। যা দেখে প্যান্ডেলের তরুণীরা পানি খেলার জন্য আগত বিভিন্ন তরুণদের সহজে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ওসব প্যান্ডেলে পানি রাখার জন্য রাখা হয়েছে বড় বড় পাত্র বা ড্রাম। পুরনো বছরের পাপ পঙ্কিলতাকে জল দিয়ে ধুয়ে মুছে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দের বহিঃপ্রকাশই রাখাইনদের সাংগ্রাই উৎসব। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত শহরে অনুষ্ঠিত জলকেলির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘুরে দেখা গেছে, রাখাইন তরুণ-তরুণীদের এ যেন এক মহাআনন্দ উৎসব। গেল বছরের দুঃখ কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে অনাগত দিনের সুখ-সমৃদ্ধির আশা রেখে আনন্দ লাভের সুযোগ ও উপায় হচ্ছেÑ এ অনুষ্ঠানের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। তাদের মতে, অনেকে নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে প্রতিবছর রাখাইনরা এ উৎসব পালন করে থাকে মহা ধুমধামের সঙ্গে। ৩ দিনের এই সুবর্ণ সুযোগে তরুণ-তরুণীদের অবাধে কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে। এক কথায়-রাখাইন প্রেমিক-প্রেমিকাদের এ যেন একেবারে চাঁদের হাট। দেখা মাত্রই কোন আড়ষ্টতা না হয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে চলেছে তারা একে অপরকে। এত দিন সামাজিক ও পারিবারিক বলয়ের কারণে নিজের প্রিয়জনকে কিছু বলতে চেয়েও তাদের মনের কথা বলার সুযোগ গড়ে উঠেনি। জলকেলি বা পানিখেলার এ সময়ে কাক্সিক্ষত ওই সুযোগটি অনায়াসে পেয়ে থাকে তারা। রাখাইন তরুণ-তরুণীদের এভাবে ঘনিষ্ট হয়ে কথা বলতে দেখে এবং সর্বোপুরি জলকেলির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেকে উৎসবোত্তর তাদের মধ্যে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় এ ভ্রান্ত ধারণা করতে পারে। কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে তৈরিকৃত একই প্যান্ডেলে যারা কিছুক্ষণ জলকেলি উৎসব উপভোগ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন, তারা অবশ্য দেখতে পেয়েছেন বিভিন্ন দলের তরুণ একজন তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছে, এবং জলকেলিতে অংশ নিয়েছে। আনন্দের আতিশ্যে নেশা জাতীয় পানীয় পান করে পাশ্চাত্যের ডিসকো, ব্রেক ড্যান্স করে উপস্থিত সকলকে মাতিয়ে রেখেছে রাখাইন তরুণীরা। তাছাড়া ছোট ছোট শিশু-কিশোর ও ছেলেমেয়েরা ছোট্ট বালতি কিংবা পানি ছিটানোর অত্যাধুনিক নানা যন্ত্র দিয়ে পরিধেয় কাপড় ভিজিয়ে দিয়েছে। তাদের রাখাইন পল্লীর অলিগলিতে ওত পেতে বসে থাকতে দেখা গেছে। যখন অভেজা লোক পায়Ñ তখনই তারা জল ছুড়ে ভিজিয়ে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করেছে। মঙ্গলবার শহরের বিভিন্ন রাখাইন পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, রাখাইনদের তৈরিকৃত প্যান্ডেলগুলোতে তরুণীরা নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে বসে রয়েছে। রাখাইন তরুণরা নানা ধরনের উল্লাস ধ্বনি ‘লে লে মংরো মংরো’ করে একটির পর একটি প্যান্ডেলে গিয়ে জল কেলিতে অংশ নিচ্ছে। তরুণের দল প্যান্ডেলে আসলে তরুণীরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। জল কেলিতে কে সঙ্গী হবে? এ ধরনের কোন নিয়মনীতি নেই বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েল ফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় নেতা ইউ ক্য থিং। তিনি আরও জানান, তরুণীদের জন্য নির্ধারিত প্যান্ডেল আছে বিধায় তারা অন্য কোন প্যান্ডেলে যেতে পারে না। তরুণরাই প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে গিয়ে নিজেদের সমঝোতার মাধ্যমে সঙ্গী ঠিক করে নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সুুযোগ-সুবিধা একটু বেশি থাকে বৈকি। কেননা কোন ছেলে যে কোন মেয়েকে আমন্ত্রণ করলে ওই মেয়েকে অবশ্যই জলকেলিতে তার সঙ্গী হতে হয়। কোন মেয়ে ওভাবে কোন ছেলেকে কোনক্রমেই আমন্ত্রণ করতে পারে না। কার্যত ছেলেদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেয়েরা সম্মত হয় বলে ছেলেরা নিজ নিজ পছন্দমতো মেয়েকে সঙ্গী করে থাকে। কক্সবাজারের রাখাইন পল্লীগুলোতে অনুষ্ঠিত জলকেলি উৎসবের দৃশ্য সকল সম্প্রদায়ের নিকট উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। শহরের হাঙ্গরপাড়া, পশ্চিম টেকপাড়া, চাউলবাজার সড়ক, পূর্ব মাছবাজার, পশ্চিম মাছবাজার, ক্যাংপাড়াসহ বিভিন্ন প্যান্ডেলে উপভোগকারী ব্যক্তিরা ঘুরে ফিরে দেখছেন। রাখাইনদের ওসব প্যান্ডেলে জলকেলি অনুষ্ঠান ছাড়াও আলোচনা সভা, প্রীতিভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন রয়েছে। এ অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ রাখাইন সম্প্রদায়ের দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছেন। রাখাইনদের জলকেলি অনুষ্ঠান ও আনন্দ উৎসব কক্সবাজারে পরিণত হয়েছে সার্বজনীন লোকজ উৎসবে। রাখাইনদের সকল বয়সী নারী-পুরুষের পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনও ওই উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে দেখা গেছে। কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতা ও আরডিএফের সভাপতি অধ্যক্ষ ক্যথিং অং বলেন, চৈত্রসংক্রান্তিক রাখাইনদের বর্ষবরণ ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ উৎসব শুরু হয়ে চলে প্রায় সপ্তাহজুড়ে। উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ‘পানি খেলা’ বা ‘জলকেলি’ বৈশাখের চতুর্থ দিন থেকে শুরু হয়। এবারের ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ বা জলকেলি উৎসব চলবে ৪ বৈশাখ থেকে ৬ বৈশাখ অর্থাৎ আজ বুধবার পর্যন্ত। আদিকাল থেকে রাখাইন নববর্ষ উপলক্ষে সামাজিকভাবে সাংগ্রে পোয়ে উৎসব পালন হয়ে আসছে। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আনন্দ-উল্লাসে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছে সবাই। এর মাধ্যমে আমরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরনো দিনের সব ব্যথা, বেদনা, হিংসা বিদ্বেষ ভুলে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এটি আমাদের কাছে খুবই পবিত্র ও উৎসবের দিন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, রাখাইনদের জলকেলি উৎসব উপলক্ষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও মাঠে রয়েছে। যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
×