ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রিমান্ডে তথ্য জঙ্গী আব্দুল্লাহর ॥ হত্যায় জঙ্গী ট্রেনিং

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

রিমান্ডে তথ্য জঙ্গী আব্দুল্লাহর ॥ হত্যায় জঙ্গী ট্রেনিং

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ব্লগার, লেখক, প্রকাশকসহ এ ধরনের ব্যক্তিদের হত্যার অনুমতি দিয়ে থাকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাত সদস্যের শরিয়াহ্ বোর্ড। বোর্ডের অনুমতিসাপেক্ষেই এ পর্যন্ত এ ধরনের ব্যক্তিদের হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ঘটেছে। অনুমতি প্রদানের পর হত্যাকা-ে অংশ নেয়া জঙ্গীদের সুবিধাজনক জায়গায় ট্রেনিং দেয়া হতো। খোদ রাজধানীতেও একাধিক ট্রেনিং সেন্টার ছিল। ট্রেনিংয়ের সময় তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হতো না। বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত মেজর জিয়াউল হকসহ অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ইতোপূর্বে গ্রেফতার হয়েছে শরিয়াহ্ বোর্ডের সদস্য রাজধানীর ফরিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক নাঈম। সর্বশেষ গ্রেফতার হয়ে ছয় দিনের রিমান্ডে শরিয়াহ্ বোর্ডের সদস্য আব্দুল্লাহ এমন তথ্য দিয়েছেন। গত ৭ এপ্রিল রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দক্ষিণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার মোঃ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পরিচালিত অভিযানে গ্রেফতার হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শরিয়াহ্ বোর্ডের সদস্য হাফেজ মাওলানা মোঃ মাকসুদুর রহমান ওরফে আব্দুল্লাহ (৩১)। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে পায় ডিবি পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাকসুদুর রহমানের সাংগঠনিক নাম আব্দুল্লাহ। পিতার নাম মোঃ মতিউর রহমান আকন্দ। মায়ের নাম মোছা. জাহানারা বেগম। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার আশ্রমপাড়া গ্রামে। তিনি ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার ফুলপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম। তিনি গ্রামের পূর্ব চাঁদশ্রী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন। ১৯৯৪ সালে কোরানে হাফেজ হতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের কালীয়ানী কান্দা বাতান হাফিজিয়া মাদ্রাসার হিফজ শাখায় ভর্তি হন। ১৯৯৯ সালে কোরানে হাফেজ হন। ২০০০ সালে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গোপিনপুর মাদ্রাসায় উর্দু শিখতে ভর্তি হন। ওই বছরই উর্দু শেখা শেষ হয়। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের কাজীরখিল মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে তিন বছর আরবী ব্যাকরণ শেখেন। এরপর এক বছর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় আরবী ব্যাকরণের ওপর পড়াশোনা করেন এবং উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত এক বছর তিনি ঢাকার লালবাগের জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় কোরানের অর্থ ও ব্যাখ্যার ওপর পড়াশোনা করেন। ওই বছরই তিনি ময়মনসিংহ সদরে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে তিনি মিশকাতের (হাদিসের অন্যতম গ্রন্থ) ওপর এক বছর পড়াশোনা করেন। সূত্র বলছে, এখান থেকে পাস করেই ২০০৭ সালে ভর্তি হন পুরান ঢাকার গে-ারিয়ায় অবস্থিত ফরিদাবাদ মাদ্রাসায়। এখানে তিনি দাওরা হাদিস (হাদিসের ওপর সর্বোচ্চ পড়াশোনা) পড়েন। দাওরা হাদিসের কিতাবুল জিহাদ (দাওরা হাদিসের একটি অধ্যায়) পড়ার সময় তিনি আস্তে আস্তে জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হন। একপর্যায়ে তিনি জিহাদ বিষয়ে আগ্রহী হন। তাকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেন একই মাদ্রাসার শিক্ষক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দাওয়াতী সেলের শীর্ষ নেতা এবং জঙ্গী সংগঠনটির শরিয়াহ্ বোর্ডের সদস্য মাওলানা মোঃ নাঈম ওরফে সাইফুল ইসলাম ওরফে সাদ (৩০)। মাওলানা সাদের সঙ্গে মাকসুদুর রহমানের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। জিহাদের বিষয়ে নিয়মিত দুজনের আলোচনা চলতে থাকে। আগ্রহ দেখে মাওলানা সাদ আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন বইপত্র, অভিও, ভিডিও মাকসুদুর রহমানকে দেন। দীর্ঘ আট বছরে মাকসুদুর রহমান পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। ততদিনে মাকসুদুর রহমানের নাম বদল হয়ে যায়। নিয়মানুযায়ী তার সাংগঠনিক নাম হয় আব্দুল্লাহ। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে আব্দুল্লাহ রাজধানীর উত্তরার দেওয়ানবাড়ির একটি জঙ্গী আস্তানায় (মারকায) দেড় মাস জিহাদ বিষয়ে সামরিক ও ধর্মীয় প্রশিক্ষণ নেন। আস্তানায় কম্পিউটার চালনা, ইমান, তাওহিদ, কাফের হওয়ার কারণ, জিহাদের ব্যাখ্যা, চাপাতি চালানো, আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, খোলা ও লাগানোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া নিরাপদে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো ও রিসিভ করা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণে মাওলানা ওসমান গণি ওরফে খায়ের নামের একজনসহ সাতজন অংশ নেন। সাতজনের মধ্যে মাওলানা আব্দুল্লাহসহ ছয়জন শরিয়াহ্ বোর্ডের সদস্য। আর মাওলানা আব্দুল্লাহর দায়িত্বশীল বা অধীন বা মাসুল হিসেবে কাজ করতে থাকেন মাওলানা ওসমান গণি। তাদের তিনজনে প্রশিক্ষণ দিতেন। নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতেন মামুন নামের একজন। মামুনকে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন সুজন নামের একজন। আরেকজন মাঝেমধ্যে আসতেন। তাকে সবাই বড়ভাই হিসেবে জানতেন। এই বড়ভাই মেজর জিয়া বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জিহাদের মাসালা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতেন মামুন আর শারীরিক কসরত করাতেন সুজন। চাপাতি, আগ্নেয়াস্ত্র, কম্পিউটার শিক্ষা দিতেন তিনজন মিলেই। অর্থাৎ মামুন, সুজন আর মাওলানা ওসমান গণি। প্রশিক্ষণ চলাকালে কাউকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হতো না। প্রশিক্ষণ শেষে তারা যে যার জায়গায় চলে যেতেন। সংগঠনের তরফ থেকে মাওলানা আব্দুল্লাহর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে সমাধান বা মতামত চাওয়া হতো। এসব বিষয়ের মধ্যে ছিল ব্যাংক থেকে টাকা ছিনতাই করা যাবে কি-না? যারা আল্লাহ ও রাসূলকে গালি দেয় তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত বা ফায়সালা করা হবে? ইসলামী আইন মোতাবেক এসবের ব্যাখ্যা দেয়া হতো। ওসমান গণি যেহেতু মাসুল (একটি গ্রুপের সামরিক প্রধান), সেজন্য তার কথায় বিভিন্ন জায়গায় সদস্যরা একত্রিত হতেন। ওসমান গণির সঙ্গে ৪-৫ মাস আগেও মাওলানা আব্দুল্লাহর সাক্ষাত হয়েছে। ওসমান গণি গ্রেফতার এড়াতে মোবাইল ফোন বা অন্য কোন প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই লোক মারফত খোঁজখবর নিতেন। এমনকি বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও ভিডিও এবং বইপত্র পাঠাতেন। রিমান্ডে আব্দুল্লাহ আরও জানান, জিহাদের মনোভাব অনুযায়ী কর্মকা- চালানোর পাশাপাশি তিনি ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এক বছর ফরিদাবাদে অবস্থিত দারুল ফিকরী ওয়াল ইরশাদ মাদ্রাসায় ইসলামী আইনের (ইফতা) ওপর পড়াশোনা করেন। এরপর একই মাদ্রাসা থেকে তিনি এক বছর মেয়াদী উলুমুল হাদিস কোর্স শেষ করেন। ২০১২ সালে তিনি একই মাদ্রাসা থেকে বাতেল ফেরকা (ভ্রান্ত মতবাদ) সম্পর্কে এক বছর পড়াশোনা করেন। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহের ফুলপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম ও সেখানকার গোদারিয়া জামিয়া মাদানিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ডিবি দক্ষিণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার মোঃ শহীদুল্লাহ জানান, আব্দুল্লাহর জবানবন্দীতে যাদের নাম এসেছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগান থানার ৩৫ নম্বর আছিয়া নিবাসের দ্বিতীয় তলার বাসায় ঢুকে চাপাতি দ্বারা কুপিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই, বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও ইউএসএআইডিতে কর্মরত থাকা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একটি সিøপার সেল। মামলাটির তদন্তের একপর্যায়ে গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহর নাম উঠে আসে। প্রতিটি জঙ্গী সংগঠনে পবিত্র কোরান-হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য শরিয়াহ্ বা মুফতি বোর্ড রয়েছে। আবদুল্লাহ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শরিয়াহ্ বোর্ডের সক্রিয় সদস্য। শরিয়াহ্ বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আজ পর্যন্ত কোন হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটায়নি। বোর্ডটির অন্যতম সদস্য সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আর চলতি বছরের ২৬ জুন শরিয়াহ্ বোর্ডের আরেক সদস্য ফরিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোঃ নাঈম ওরফে সাইফুল ইসলাম ওরফে সাদকে (৩০) তার এক সহযোগী রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানার আল আরাফা ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক সোহেল আহম্মেদ ওরফে সোভেলসহ (৩২) গ্রেফতার করা হয়।
×