ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দলিত জীবনকথা

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

দলিত জীবনকথা

সমাজে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ বসবাস করে থাকে। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও পৃথকত্ব রয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মধ্যে ছোট-বড় তুলনা চলে না। কারণ প্রত্যেকেই মানুষ আর মানুষ মানুষেরই জন্য। প্রতিটি মানুষেরই থাকা সঙ্গত সমান মানবাধিকার। তবু পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তির পেশাগত পরিচয়টিকে বড় করে দেখে মানুষে মানুষে দূরত্ব রচিত হয়। বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হয় একই সমাজে অবস্থানকারী কোন কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ। শ্রমের মর্যাদাটি সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলে এমনটা হতো না। প্রতিটি পেশার মানুষই সমমর্যাদা পেত। এখনও আমাদের সমাজে বর্জ্য অপসারণ কিংবা নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার কাজে যে পেশাজীবীরা নিয়োজিত তাদের নিচু চোখে দেখার প্রবণতা রয়ে গেছে। অথচ পরিবার বা সমাজে প্রতিটি কাজেরই আবশ্যকতা রয়েছে। নিত্য ব্যবহার্য শৌচাগার পরিচ্ছন্ন রাখতেই হবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত কারণে। সেই কাজটি ব্যক্তি নিজেও করতে পারেন, কিংবা অন্যকে দিয়ে করাতে পারেন। কিন্তু কাজটি জরুরী, এটি এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। ছবি সত্য বলে। ছবি সরাসরি তুলে ধরে বাস্তবচিত্র। একটি ছবি হাজার শব্দের চাইতেও শক্তিশালী ও সংবেদনময় হয়ে উঠতে পারে যদি তেমন ছবি হয়। সম্প্রতি ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের অর্থায়নে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেসে দলিত মানুষের জীবননির্ভর আলোকচিত্র প্রদর্শনী ইট-পাথর-সিমেন্টের মহানগরীর মানুষের চোখে বিস্ময় ও বেদনা জাগাতে সমর্থ হয়েছে। আলোকচিত্রশিল্পী আকাশ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়ার সুইপার কলোনি বা মেথরপট্টি কিংবা যেখানে ধাঙ্গড়রা আবাসস্থল গড়ে তুলেছেন সেসব জায়গায় তাদের জীবনপ্রণালী খুব কাছে থেকে দেখেছেন। সেই জীবনচিত্র নিষ্ঠার সঙ্গে শিল্পসম্মতভাবে আলোকচিত্রে ধারণ করেছেন। দলিতদের বহুতল আবাসনের ছবিটিতে রোদে মেলে দেয়া তাদের পোশাকের বিচিত্র কড়া রং এক আশ্চর্য দ্যোতনা তৈরি করেছে। আরেকটি প্রতীকী আলোকচিত্রের দেখা পাবেন দর্শকেরা। সেটি হলো তাদের কাপড় ধোয়ার স্থান। বর্গাকার সিমেন্টের ছাদ, যেটি ভূতলে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থারই একটি অংশ, সেই পরিসরটিকে পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করে তার ওপরে চারদিকে ঘরের মেয়ে ও বউয়েরা কাপড় কাচতে বসেছেন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় পাটাতনের অদূরে চারপাশজুড়ে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ রীতিমতো ভাগাড়খানার আদল নিয়েছে। তার অর্থ হলো বিবিধ বিচিত্র নোংরা বস্তুর মাঝখান থেকে নারীরা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য পরিচ্ছন্নতা সংগ্রহ করে আনছেন। জীবন যেমন, ছবিগুলো সেটাই অবিকল তুলে এনে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যাদের আমরা দেখেও দেখি না তারাও রয়েছেন বেঁচে এবং কষ্ট ও দুর্দশার ভেতরেও তারা জীবনযাপন করছেন, জীবন উপভোগ করছেন। এই ছবি দর্শকের মনে আনন্দ ও বেদনার যুগপৎ এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এক ধরনের হাহাকারও জন্ম নেবে সংবেদনশীল দর্শক হৃদয়েÑ ইশ ওদের জীবনটা যদি আরেকটু সচ্ছল ও বিঘœহীন হতো। একখানা পানির পাইপ থেকে যদি গুচ্ছ গুচ্ছ পরিবারের কলস ভরতে না হতো। এই বোধটুকুর জন্মও গুরুত্বপূর্ণ নয়। আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের মতো অভিজাত গ্যালারির দর্শক তো অভিজাত শ্রেণীরই হবেন। শিল্প মানব মনে অভিঘাত জন্ম দেয়, সেই অভিঘাত থেকে পরিবর্তনের সূচনা হওয়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সমাজে যারা প্রায় অদৃশ্য সেইসব মানুষের জীবনে খানিকটা স্বস্তি এনে দেয়া এবং অস্পৃশ্য অচ্ছুত জ্ঞান করার মধ্যযুগীয় মনমানসিকতার পরিবর্তনে প্রদর্শনীর আলোকচিত্রমালা ভূমিকা রাখুকÑ এমন প্রত্যাশাই আমাদের।
×