ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কওমী শিক্ষার আধুনিকায়ন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

কওমী শিক্ষার আধুনিকায়ন

যেসব মানবসন্তান লাগামহীন শিক্ষা-দীক্ষায় শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত হয়ে বেড়ে উঠেছে, সমাজের বোঝা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, ইহজাগতিক বোধ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে, তাদের বিধিবিধান, নিয়মকানুন আর ইহলৌকিক শিক্ষার আবরণে আবৃত করা না গেলে সে দানবে পরিণত হতে পারে। দানবিকতা কখনই মানবিকতাকে মেনে নিতে পারে না। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কওমী মাদ্রাসাগুলো যেন মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ, যেখানে পৌঁছে না ইহজাগতিকতার সামান্য আলোও। যদি পৌঁছত তা হলে দেশের পনেরো হাজারের বেশি কওমী মাদ্রাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কর্মজীবন অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধির সন্ধান পেত; চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তারা বড় বড় সুযোগ পেতে পারত। দেশ পরিচালনার নানা ক্ষেত্রে তারা দায়িত্ব পালনে হতো সক্ষম। কিন্তু এই শিক্ষার্থীরা দেশের মূলধারার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মতো কোন সরকারী চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পায় না। কেননা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সরকার স্বীকৃত নয়। ফলে কওমী শিক্ষা সনদহীন। তদুপরি এসব প্রতিষ্ঠানে নেই সরকার অনুমোদিত কোন পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাস। নেই অনুমোদিত বোর্ড। ফলে তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত সতেরোটি জাতীয় ও আঞ্চলিক বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে কওমী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে যে ডিগ্রী অর্জন করে তা সরকারী স্বীকৃতিহীন দশকের পর দশক ধরেই। অভিযোগও রয়েছে যে, কওমী মাদ্রাসাসহ সরকারী মাদ্রাসায় পড়ানো হয়ে আসছে মওদুদী, একমাত্র প্রতিষ্ঠান জামায়াতে ইসলামী ইত্যাকার বিষয়। জাতীয় সংসদেও অভিযোগ তোলা হয় যে, কওমী মাদ্রাসা বোর্ডের পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশের জন্ম’ প্রবন্ধে স্বাধীনতা দিবসের কোন তথ্য নেই। বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিভাত। সরকারী অনুদানপুষ্ট অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই এখন সীমিতভাবে হলেও বাংলা, ইংরেজী ও বিজ্ঞান শিক্ষা চালু রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে অনুমোদিত ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত স্নাতকদের উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তির সুযোগ বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে। অস্বীকারের উপায় নেই যে, কওমী মাদ্রাসা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তদুপরি কওমী শিক্ষাকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা ও শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নত করতে ২০১২ সালে সরকার সতেরো সদস্যের কওমী মাদ্রাসা জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে। তাদের সুপারিশের আলোকেই এর শিক্ষা সরকারী স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে সংসদে বিল আনার পূর্বে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রীর স্বীকৃতি দেয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কওমী শিক্ষাকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নেয়া একই সঙ্গে জরুরী। কারিকুলাম পরিবর্তন এবং এই শিক্ষা বোর্ডকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনা হলে তা মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য। তবে শর্তহীনভাবে সনদ প্রদান যৌক্তিক নয়। অযথা স্বীকৃতি নয়, প্রয়োজন সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলো কওমী মাদ্রাসাকে ব্যবহার করছে সহিংস রাজনীতিতেও। মাদ্রাসাগুলোর সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পরিচালনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দলের নেতারা রয়েছেন। তাই তারা একে ব্যবহার করে আসছেন অপরাজনীতির কাজে। কোন হীন রাজনৈতিক স্বার্থে এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ বাধাগ্রাস্ত করার অপচেষ্টা জাতির জন্য ক্ষতিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইছেন বিপুল জনগোষ্ঠী যেন আলোকিত হতে পারে সঠিক শিক্ষার আলোয়। তাই কওমী শিক্ষা বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নততর করার সরকারী পদক্ষেপ যেন হয় যথাযথ। জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধী তৈরি কারখানা নয়, কওমী শিক্ষা হোক মানবজীবনসম্পৃক্ত ধারায় সমৃদ্ধ। কওমী শিক্ষায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ গঠন করে তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
×