ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লোকলজ্জায় ও ঘৃণায় জঙ্গী সন্তানের লাশ নিচ্ছে না পরিবার

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৮ এপ্রিল ২০১৭

লোকলজ্জায় ও ঘৃণায় জঙ্গী সন্তানের লাশ নিচ্ছে না পরিবার

শংকর কুমার দে ॥ ছিঃ ছিঃ সন্তান জঙ্গী ! লোকলজ্জা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিন্দা, ধিক্কার, ভয়ে জঙ্গীর লাশ গ্রহণ করছে না তাদের পরিবার পরিজন। বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হচ্ছে জঙ্গী আস্তানায় নিহত জঙ্গীদের লাশ। জঙ্গী হওয়ার কারণে পরিবার-সমাজের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রকৃত পরিচয়। জঙ্গী হয়ে নিহত হওয়ার প্রিয় সন্তানের মুখ পর্যন্ত দেখতে আসছেন না পরিবারের কেউ। সারাদেশে গত এক বছরে বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে প্রায় অর্ধশত জঙ্গীর লাশ। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা বলেন, এই তো জঙ্গী হওয়ার ভাগ্য, জঙ্গী জীবন! পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নয়তো আত্মঘাতী হামলায় নিহত জঙ্গীর লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে পড়ে থাকে মর্গে। নিহত জঙ্গীর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি, ময়নাতদন্ত সম্পন্ন, ডিএনএ পরীক্ষা ইত্যাদি প্রক্রিয়া শেষে লাশ গ্রহণের জন্য পরিবারের লোকজনদের খবর দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কিংবা আত্মঘাতী হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনার পর পরই নিহত জঙ্গীর পরিবার থেকে বলা হচ্ছে, ছিঃ ছিঃ তারা দেশের শত্রু, অপরাধী, আমরা লাশ নেব না। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, যারা আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয়েছে তাদের পরিচয়ই খুঁজে পায় না পুলিশ। মর্গে লাশ শনাক্ত করতে আসে না পরিবারের কেউই। অগত্যা যদি কেউ লাশ নিতে না আসে তাহলে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে বা পুলিশের পক্ষ থেকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার ঘটনার পর থেকে নিহত জঙ্গীদের লাশ নেয়নি তাদের পরিবার পরিজন। দীর্ঘদিন লাশ পড়ে ছিল মর্গে। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করতে এগিয়ে আসে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয় জঙ্গীর লাশ। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে সিলেটের শিববাড়ি ও মৌলভীবাজারের নাসিরনগর ও বড়হাটের জঙ্গী আস্তানায় নিহত জঙ্গীদের শিশু সন্তান, নারীসহ ১৪ জনের লাশ দাফন করা হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে। পরিবারের কেউই লাশ নিতে আসেনি। কোন কোন লাশ বিকৃত হয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, শনাক্ত করার মতো অবস্থা নেই। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি থেকে শুরু করে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া, রাজধানীর কল্যাণপুর, আশকোনা, আজিমপুর, মিরপুরের রূপনগর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্নস্থানে প্রায় অর্ধশত জঙ্গী নিহত হয়েছে, যাদের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এ ছাড়াও আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয়েছে আরও বেশ কয়েক জঙ্গী যাদের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবেই দাফন করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে নব্য জেএমবি বা সারোয়ার-তামিম গ্রুপের জঙ্গীদের লাশ। সংখ্যার দিক দিয়ে কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় সর্বাধিক সংখ্যক নিহত ৯ জঙ্গীর লাশই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এরপরেই সিলেটের শিববাড়ি ও মৌলভীবাজারে শিশু সন্তান ছাড়া অন্তত ৭ জঙ্গীর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় জঙ্গী তামিম আহম্মেদ চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, তানভির কাদেরী, মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম মারজানের লাশও বেওয়ারিশ হিসেবেই দাফন করা হয়েছে। এসব জঙ্গীরা নিহত হওয়ার আগেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সন্তান জঙ্গী হওয়ার কারণে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনকে লোকলজ্জা, মানসম্মানের ভয়ে মাথা নিচু করে চলতে হচ্ছে সমাজে। এ জন্য প্রিয় সন্তানের মুখখানি শেষবারের মতোও দেখতে চায় না জঙ্গীর পরিবার পরিজন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর গত এক বছরে দেশে বড় ধরনের কোন জঙ্গী হামলা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যখনই জঙ্গী আস্তানার খোঁজ পেয়েছে তখনই জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করেছে। রাজধানী ঢাকার আশকোনা এলাকায় র‌্যাবের ব্যারাকে ও খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের চেকপোস্টে দুই জঙ্গী পৃথক দুইটি ঘটনায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা ছাড়া কোন জঙ্গী হামলা ঘটেনি। তবে আত্মঘাতী জঙ্গীসহ জঙ্গীরা গোপন জঙ্গী আস্তানায় রয়েছে, যা সংখ্যায় একেবারেই নগণ্যসংখ্যক। তবে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে জঙ্গীদের সমাজে ঘৃণিত হয়ে লুকিয়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। নিহত হওয়ার পরও তারা এতই ঘৃণিত যে, পরিবার পরিজন গ্রহণ করছে না, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন হচ্ছে।
×