ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপশক্তির বিরুদ্ধে সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৮ এপ্রিল ২০১৭

অপশক্তির বিরুদ্ধে সংস্কৃতি

নিষেধাজ্ঞাসহ নিরাপত্তার ঘেরাটোপে এবারের নববর্ষ উৎসব পালিত হলেও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না। তদুপরি বাংলা নববর্ষ পালনের অন্যতম অপরিহার্য অনুষঙ্গ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন ছিল বাংলাদেশজুড়ে। আশার কথা এই যে, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীসহ কতিপয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর বাংলা নববর্ষ পালন ও মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তাতে আদৌ কর্ণপাত করেনি। এ বিষয়ে সরকারপ্রধানের বক্তব্যও ছিল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনÑ নববর্ষ পালন ও মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। অতঃপর জাতিÑধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর বাঙালী ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে শামিল হয়েছে। এবারের বর্ষবরণে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের ৫০ বছর পূর্তি। বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান মঙ্গল শোভাযাত্রা লাভ করেছে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি, যা এবার ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ছায়ানটের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে রমনা বটমূলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন যা বলেছেন তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, অপশক্তি তথা মৌলবাদ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে নয়, বরং শিক্ষা ও সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। শহরে-নগরে আবদ্ধ না থেকে সবাইকে যেতে হবে গ্রাম-গঞ্জে-লোকালয়ে। সবাইকে বোঝাতে হবে, জানাতে হবে বাঙালী ও বাঙালিত্ব কী। কোন্টি বাঙালীর সংস্কৃতি, আর কোন্টি অপসংস্কৃতি। ধর্ম ব্যবসায়ী ও মৌলবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে। আর এর প্রধান অবলম্বন হবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি। এর জন্য প্রয়োজনে ফিরিয়ে আনতে হবে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সংগ্রামের চেতনা। অন্যদিকে এই চেতনার ধারক-বাহক হয়ে আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন ও স্থাপনায় যাত্রা শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেগুনবাগিচায়। দীর্ঘ ২১ বছর তিল তিল করে গড়ে তোলার পর বর্তমানে এটি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো নিজস্ব পরিকল্পিত ভবনে। এই জাদুঘরে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র, দলিলপত্র, চিঠি, বার্তাসহ অন্তত সাড়ে ১৭ হাজার নিদর্শন ঠাঁই পেয়েছে। আরও সংগৃহীত হচ্ছে, যা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। ৩০ লাখ শহীদের দেশে, দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর দেশে, সশস্ত্র সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই। এখন সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর; সময় এসেছে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের। আমরা যদি দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়েক কোটি শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সুমহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চেতনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে, তাহলে জঙ্গীবাদ কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সত্য বটে, বর্তমানে শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব আজ বিপন্ন। জঙ্গী ও সন্ত্রাস কবলিত হয়ে মানব সভ্যতা বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইরাক-সিরিয়া-পাকিস্তান-আফগানিস্তান নয়; বরং জঙ্গী হামলা হচ্ছে ইউরোপ-ফ্রান্স-ইতালি-যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায়। সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সর্বোপরি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র আপাতদৃষ্টিতে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা ও সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রায় ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অনিবার্য প্রাণ যাচ্ছে অগণিত নিরীহ সাধারণ মানুষের, নারী ও শিশুর। ঘটছে সম্পদহানিও। জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদকে সশস্ত্র উপায়ে দমন করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে মানুষের মধ্যে সুপ্ত শুভবোধ ও চেতনাকে যদি জাগ্রত করা যায়, মানবিকতা যদি বিকশিত করে তোলা যায় মানুষের মনে, তাহলে জঙ্গীবাদ একেবারে নির্মূল না হোক, অন্তত কমে আসবে অনেকাংশে। সংস্কৃতি বলে মানবতার বিকাশের কথা। এই কাজটি তৃণমূল থেকে শুরু করতে হবে শিক্ষক, ধার্মিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সম্মিলিতভাবে। আলো দিয়ে আলো জ্বালাতে হবে মানুষের হৃদয়ে ও মনে।
×