ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

সেই সত্য যা রচিবে তুমি

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৭ এপ্রিল ২০১৭

সেই সত্য যা রচিবে তুমি

সেই সত্তর দশকে কলকাতার কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ ‘আলেকজান্ডার বিক্রি করেন দাঁতের মাজন’ এপারেও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। গ্রন্থের নামকরণই টেনেছিল বেশি। আর একালে এসে বিএনপি-জামায়াত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রচনা করলেন মিথ্যাচারে পূর্ণ বাক্য, ‘শেখ হাসিনা বিক্রি করেন দেশ।’ এ নিয়ে কত খেদোক্তি যে তিনি রাতভর উগড়াতে থাকেন, তার কিছু আসে গণমাধ্যমে, কিছু উবে যায় বাতাসে, মিলিয়ে যায় শূন্যে। রাস্তার পাশে সর্বরোগের মহৌষধ বিক্রেতা ক্যানভাসার যেভাবে তার বাকশিল্প প্রয়োগ করে ডুগডুগি বাজিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করেন, বিক্রি করেন তার ওষুধ, সেভাবে মিথ্যাচার ফেরি করে না বেড়ালেও মিথ্যার ফানুস ওড়াতে পছন্দ করেন জামায়াত-বিএনপি নেত্রী। একালের কবিও হয়তো লিখতে পারেন, ‘খালেদা জিয়া ফেরি করেন মিথ্যাচার।’ তবে সবসময় যে মিথ্যা বলে আসছেন, তা হয়তো নয়। মাঝে মধ্যে নিজের কর্মকা-কে যখন অন্যের জন্য নিষিদ্ধ করে তোলেন, তখন সত্য বেরিয়ে আসে এই যে তিনি নববর্ষের দিন ভাষণে ‘দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কারও হস্তক্ষেপ মেনে নেব না’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন, এটা কার প্রতি? নিজের প্রতিই হতে পারে। দেশের জনগণও এটা চায় যে, কেউ হস্তক্ষেপ না করুক। বেগম জিয়া এখনও মনে করেন ‘বাংলাদেশের অবস্থা দেখে অনেকে এগিয়ে আসতে চায়, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য।’ এ যে সত্য সকলি সত্য। এই ভাষ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ নেই। কারণ, এই অভিজ্ঞতা অর্জন তার একার, তিনি এপথেই পাড়ি দিয়ে আসছেন। বিদেশী দেখলেই নালিশ জানাতে এগিয়ে যাওয়ার চর্চাটাও অনেকদিনের। এই অভ্যাস পরিত্যাগ করার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। এই যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় সফরে এসেছিলেন; তখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, চেষ্টা-চরিত্তির করে প্রথমে সদলবলে ও পরে একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাক্ষাতের ঘটনা স্বাভাবিক বৈকি। কিন্তু কী করেছেন সেই একান্ত সাক্ষাতে? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মোদির হস্তক্ষেপ কামনাই শুধু নয়, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগের ফর্দ পাঠ করে শুনিয়েই ক্ষান্ত হননি, তা মোদির হাতেও তুলে দেন। ক্ষমতাসীন সরকারকে সহযোগিতা না করার মতো বাক্য উচ্চারণে তিনি থেমে ছিলেন না। দেশবাসী তার এই ক্রিয়াকলাপকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে, তা কিন্তু নয়। ভারত বিরোধিতার খ্যাতি পাওয়া জামায়াত-বিএনপি জোট নেত্রী মোদি নির্বাচিত হওয়ার পর ‘প্রাণে খুশির তুফান ছুটেছে’ বলে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে না উঠলেও বসন্তে রঙিন হয়ে ওঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে কত কী করেছেন। মোদিকে অভিনন্দন জানানোর মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল না। বিএনপি নেতারা দিল্লীতে গিয়ে কতভাবেই না ধর্ণা দিলেন। দিল্লীতেই বিএনপি নেতারা ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে দফায় দফায়। এসব কার্যকলাপ বেগম জিয়ার মতে অবশ্য, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ মনে হবে না। কারণ, তিনি বিদেশী সহায়তা চান, শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। সে জন্য ভারতের প্রতি নতজানু হতে সময় নেয়নি। কিংবা এই যে গত দশ বছরে বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করে তিনি তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দিয়েছেন বলেই, হ্যারি কে টমাস, মোজেনা নামক মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা ভাইসরয়দের মতো আচরণ করে গেছে। সবই বেগম জিয়ার বদান্যতায়। চক্ষুলজ্জার শেষ বিন্দুটাকেও বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দিয়ে বেগম জিয়া কূটনীতিকদের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধও করেছিলেন। কিন্তু এসব কেন করেছিলেন কিংবা এখনও করছেন? দেশবাসীর কথা মাথায় রেখে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মানুষের জন্য এত কিছু আয়োজন তিনি করেছেন তা নয়। এমনকি নানা ষড়যন্ত্র, এত গোপনীয়তা, এত আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ তিনি করেছেন। এমনকি পেট্রোলবোমা মেরে দেড় শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন, সবই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাই অন্ধকারে চোরাগোপ্তা পথে হাঁটতে হচ্ছে। আলোর মশাল সেই কবেই নিভে গিয়েছে। বিএনপি নামক দলটির এসব ক্রিয়াকলাপ, নির্লজ্জ আচরণ, কথায় কথায় বিদেশীদের কাছে অভিযোগ স্রেফ ক্ষমতার জন্য। জিভ-লকলক উদগ্রতায় বীতশ্রদ্ধ হচ্ছেন। সে বিচারবোধও ভুলে গেছেন ক্ষমতালোলুপ বেগম জিয়া ও তার দলীয় নেতারা, অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন তারা। ক্ষমতার লোভ মোহাচ্ছন্ন করে দিয়েছে স্বাভাবিক বিচারদৃষ্টিকে। কে তাদের মনে করিয়ে দেবে, অন্ধ হলে কিন্তু প্রলয় বন্ধ থাকে না। জনরোষ যদি তীব্র হয়ে ওঠে, তখন তা সামলানো দায় হয়ে পড়বে। জনসমর্থন না থাকা এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রাজনীতিকদের কাছে কোনটাই আর নীতি-নিয়মের বালাই নেই। তাই তারা সৌজন্য লঙ্ঘনের চেয়েও অনেকখানি নিচে নেমে যেতে পারেন। শালীনতার গ-িটাকেও টপকে যেতে পারেন। শালীন-অশালীনের মাঝে যে স্পষ্ট ভেদরেখাটা রয়েছে সেটা হয়তো তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। যে কারণে ঢাকায় সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচী দেন-দরবার করে আদায় করার পর বেগম জিয়া সাক্ষাত করেননি। অনেককাল পরে কারণ দেখান যে, তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় ছিল। বালখিল্যতার এই এক উদাহরণ বটে। স্পর্ধা এবং অতিস্পর্ধা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু তার জের সৌজন্য ভুলিয়ে দেবে? শালীনতার সীমা অক্লেশে অতিক্রম করিয়ে দেবে? রাজনীতির যেমন তেমন স্তর থেকে আবার নয়, শীর্ষ স্তর থেকেই এই শালীনতা বিবর্জিত উল্লম্ফন কোন সুস্থতার পরিচায়ক নয় অবশ্যই। এমনিতেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় মর্যাদার ন্যূনতম বোধ থাকা একদম না পছন্দ বেগম জিয়ার। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি সম্বোধন করেন ‘সে’। ভব্যতা এখানে ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। এই সম্বোধন যতটা তার প্রতিপক্ষের জন্য মর্যাদাহানিকর, তার চেয়েও বেশি করে মর্যাদাহানিকর তার নিজের জন্য। অবশ্য এটা বোঝার মতো বোধকে তিনি সক্রিয় রাখায় অনাগ্রহী। যে দায়িত্বশীল পদে তিনি আসীন, সেই পদের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হলে, সম্বোধনের ভাষা হতো মর্যাদাকর, তুই তোকারিতে পর্যবসিত হতো না। রাজনৈতিক ময়দানে কুরুচিকর মন্তব্য তার বেশ কয়েকবার ধ্বনিত হয়েছিল। জনপরিসরে সেসব মন্তব্য নিন্দিত এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তা সত্ত্বেও তিনি সেই অবস্থান থেকে একচুলও সরে আসেননি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে বিনয়ভঙ্গিতে বেগম জিয়াকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেও জবাবে তিনি যে ভাষা ও ভঙ্গিমা ব্যবহার করেছেন, তা দেশবাসীকে বিস্মিত করেছিল। দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে পৌঁছেও যদি এই কথাগুলো খেয়াল না থাকে, তা হলে নিম্নবর্তী স্তরগুলোতে রাজনৈতিক মূল্যবোধের কোন অবনমনের সাক্ষী হতে হবে ভবিষ্যতে, তা নির্ঘাত ভেবে দেখবেন না বিএনপি-জামায়াত নেত্রী, সেটাই স্বাভাবিক। যদি বা এসব বক্তব্যের দ্যোতনা শুধু রাজনৈতিক অশালীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সামাজিক-নীতিটাকেও প্রকা- রূপে সামনে এনে দেয়। ভারতের হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতাসীন সরকারের অনুকম্পা এখনও চায় বিএনপি-জামায়াত। অতীতে তা পাওয়ার জন্য নানা পথ ও পন্থা অবলম্বন করেছে। ধরেই নিয়েছিল জামায়াতের মতোই মৌলবাদী দল হিসেবে বিজেপির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা সহজ হবে। কংগ্রেসের পতনের পর কংগ্রেস মিত্র আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে যেহেতু বিজেপি, সুতরাং জামায়াত সঙ্গী বিএনপির দিকে ঝুঁকবেন মোদি। কিন্তু হা হতোস্মি! নেত্রী বুঝতেই পারেননি যে, মোদি অর্বাচীন নয়। বিবিসি’র সাংবাদিক মার্ক টালি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন বছর তিনেক আগে যে, বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী কথা বলে দক্ষিণ ও চীনাপন্থীদের এক গোয়ালে জড় করেছিলেন জিয়া।’ এই জিয়াই ১৯৮০ সালে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করেছিলেন। খালেদা ২০০২ সালে দিল্লী গিয়ে সেই চুক্তি নবায়ন করেছিলেন। আর শেখ হাসিনা ট্রানজিট ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিলে বেগম জিয়া চেঁচামেচি শুরু করেছিলেন, ভারতীয় সেনা ও অস্ত্র পরিবহন হবে এই ট্রানজিটের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। খালেদা জিয়া ২০০২ সালে চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেছিলেন। চুক্তির আগে ও পরে জনগণকে তা অবহিত করা দূরে থাক, জাতীয় সংসদেও উত্থাপন করেননি। মিথ্যা ও মোনাফিকের রাজনৈতিক রাজনীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আর ভারত বিরোধিতা ও পাকিস্তানী মানসিকতার পরিচয় দিয়ে আসছেন বেগম জিয়া। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বেগম জিয়া বিদেশীরা নাক-গলাবে-এমনটা চেয়ে আসছেন। সে কারণে স্বনামে মার্কিন পত্রিকায় পত্র লিখে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদন করেছিলেন। তার সেই আবেদন কার্যকর হয়েছে এমনভাবে ড. ইউনূসের বন্ধু হিলারির মাধ্যমে। যা আজও বহাল বাংলাদেশকে আইএস আইএর উপযুক্ত ঘাঁটি গড়তে। বেগম জিয়াকে নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যে টাকা-পয়সা দিয়েছিল, তা তাদের সংসদেই উদঘাটিত হয়েছে। যা কার্যবিবরণীতেই রয়েছে। বেগম জিয়া মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তর করায় যথেষ্ট পারদর্শী। তার এই গুণাবলী চমৎকৃত করতেই পারে জাতিকে, কিন্তু বাস্তবে তা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। আয়নায় নিজ মুখ যদি দেখতে পেতেন, বুঝতেন, কী ক্ষতিকর অবস্থানে তিনি। মিথ্যা দিয়ে যা রচনা করেন, সবই তার কাছে সত্যি হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছিলেন, রাম জন্মভূমি নিয়ে সেই অমোঘ কথা, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি। বেগম জিয়ার সবভাষ্যই আজ দুর্জনের উবাচে পরিণত।
×