ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখে চট্টগ্রামবাসীর মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

বৈশাখে চট্টগ্রামবাসীর মিলনমেলা

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ পাহাড় আর সবুজের বেষ্টনীতে শতবর্ষী গাছের ছায়ায় চট্টগ্রামে বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়েছে । ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এ আয়োজনকে উপভোগ করেছে নগরবাসী । চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে ডিসি হিলের গানবাজনা ছাড়াও শিরীষতলায় ছিল বলীখেলার আয়োজন। তবে এ খেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলা নয়। একটি ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সাহাবউদ্দিনের আয়োজনে এই বলীখেলা চলছে গত কয়েক বছর ধরে। শিরীষতলায়ও ১৪২৪ বর্ষবরণের এ দিনে বলীখেলায় লড়েছে দিদার বলী ও সামসুদ্দিন বলী। তবে চ্যাম্পিয়ন থেকে নড়েনি দিদার। আগামী ২৫ এপ্রিল লালদীঘি ময়দানে জমে উঠবে জব্বারের বলীখেলা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে চারুকলা ইনস্টিটিউটের একাত্তর শিক্ষার্থী নগরীতে প্রায় ৭০ হাজার বর্গফুট আল্পনা এঁকে মুড়িয়ে দিয়েছে সড়ক। দুর্বৃত্তদের পোড়া মবিলে যখন চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থাকা দেয়ালে আঁকা বাঙালীর গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঢেকে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটায় মৌলবাদী চক্র। ঠিক তখনই চারুকলার শিক্ষার্থীরা উদ্যোগ নেয় বৈশাখের আগের রাতেই আল্পনায় সাজিয়ে আগতদের উৎসর্গ করে দেয়া হবে তাদের কর্মযজ্ঞ। এ ছিল চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো সেরা আয়োজন। রাতভর আল্পনা শেষে সূর্যের আলো যখন পূর্ব গগনের অন্ধকার ছাড়িয়ে আলোতে পরিপূর্ণ করেছে তখনই শেষ হয়েছে চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের আল্পনা। আবার ডিসি হিল থেকে শিরীষতলা মাত্র কয়েক মিনিটের রাস্তা। কিন্তু জনসমাগম পেরিয়ে সিআরবির শিরীষতলা থেকে ডিসি হিল পর্যন্ত হেঁটে যেতে সময় লেগেছে আধঘণ্টারও বেশি। অন্যবারের তুলনায় এবারের বর্ষবরণ ছিল আরও জাকজমক ও বাঙালিয়ানায় পরিপূর্ণ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন গানে গানে আর আবৃত্তির ছোঁয়ায় আনন্দের বন্যা বয়ে দিয়েছে আগতদের মাঝে। বছরে মাত্র একটি দিন। এমন উৎসবের আয়োজন যেন নগরবাসী চায় প্রতিদিন। কিন্তু আদৌ সম্ভব না হলেও মানুষের এ ইচ্ছে থেকে যাচ্ছে আগামী পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় বৈশাখকে বরণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা আয়োজন এবং মেলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থীই যেন বাদ পড়েনি এ আঙ্গিনা না মাড়িয়ে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মজীবীরা পর্যন্ত পরিবার-পরিজন নিয়ে হাজির হয়েছেন তরুণ সমাজের আয়োজনে গড়া বৈশাখী মেলায়। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত আর কর্ণফুলীর মোহনায় থাকা নেভাল একাডেমি ঘেঁষে চলা ভিআইপি সড়কটিও ছিল বৈশাখী উৎসবে মেতে ওঠা মানুষের ঢলে রঙিন। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে এ আয়োজনে কোথাও শোনা যায়নি ইংরেজী, হিন্দী অথবা অন্য ভাষার কোন শব্দ। বাংলাকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে বাঙালী যে অবদান রেখে যাচ্ছে তা ভাষার জন্য চিরস্বীকৃত। কর্ণফুলীর মোহনা থেকে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে অনেকেই বৈশাখের এ উৎসব পালন করতে তৃপ্তি মিটিয়েছে। লৌহজংয়ের পদ্মা পাড়ে পর্যটকের ঢল মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, বাংলা নববর্ষে পদ্মা পারে পর্যটকদের ঢল নেমেছিল। শুধু মাওয়ায়ই নয়, পর্যটকদের ভিড় ছড়িয়ে পড়ে লৌহজংয়ের পদ্মা রিসোর্ট, মাওয়া রিসোর্ট ও পদ্মাপারের শিমুলিয়া ফেরিঘাটসহ কয়েক কি.মি. বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ আশে পাশের জেলা-উপজেলা থেকে পর্যটকরা এসেছিলেন সপরিবারে। আবার কেউবা এসেছেন একাকি আর প্রেমিক যুগলরা এসেছেন একে অন্যের হাত ধরে। উপভোগ করেছেন বালুচরে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ, নদীতে গোসল করা আর পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত যাবার অভাবনীয় দৃশ্য দেখা। পদ্মা সেতুর কাজের জন্য মাওয়া চৌরাস্তা বরাবর দক্ষিণের পদ্মা সংরক্ষিত থাকলেও পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় ছড়িয়ে পড়ে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে পদ্মাপারে। শুধু পদ্মাপারই নয়, পর্যটকদের ভিড় ছিল ধলেশ্বরীর মুক্তারপুর ব্রিজ, সিরাজদিখানের ইছাপুরার এম জে রিসোর্ট ও ঢালী রিসোর্ট, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সিরাজদিখানের ধলেশ্বরী-১ ও ২ সেতু, শ্রীনগরের রাঢ়ীখালের স্যার জগদীস চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশনের পিকনিক স্পটেও। নববর্ষে শুক্রবার শিমুলিয়া সীবোট ঘাটের পূর্বদিকে পদ্মাপারের বালুচরে পর্যটকদের ভিড় ছিল নজর কাড়ার মতো। রাজধানী ঢাকার যানজটে ত্যক্ত-বিরক্ত নগরবাসী সীসাযুক্ত বাতাস থেকে একটু হাঁফ ছেড়ে মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে এসেছিলেন রাজধানী ঢাকার অনতিদূরের এই পদ্মাপারে। কেরানীগঞ্জ, দোহার, মুন্সীগঞ্জ, সিরাজদিখানসহ কাছাকাছি বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকেও পর্যটক এসেছিলেন পদ্মার নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব মিলে একেকটি গ্রুপ করে এসেছিলেন বেড়াতে। আবার অনেক প্রেমিক যুগল এসেছিলেন একে অন্যের হাত ধরে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বালুময় এই পদ্মাপারে। অনেকে আবার নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করে চলে গেছেন পদ্মা নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরগুলো ঘুরে বেড়াতে। সেখানে মজা করে বিভিন্ন খেলায় মেতে ছিলেন পর্যটকরা। বান্দরবানে পানিখেলায় মাতোয়ারা আদিবাসী নিজস্ব সংবাদদাতা বান্দরবান থেকে জানান, বান্দরবান পার্বত্য জেলার মারমা সম্প্রদায় তাদের নববর্ষবরণ উৎসব ‘সাংগ্রাই’র জলকেলিতে মেতে উঠেছিল। শনিবার বিকেলে জেলা শহরের রাজারমাঠ ও রেইছা এলাকাসহ জেলার সব উপজেলায় জলকেলিতে মেতে ওঠে তারা। মারমা আদিবাসীর এই জলকেলি উৎসব পাহাড়ী-বাঙালীর মিলন মেলায় পরিণত হয়। দেশে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে পর্যটকরা। শহরের রাজবাড়ীর মাঠে জলকেলি উৎসবে যোগ দিয়ে বিকেল থেকে দলে দলে মারমা তরুণ-তরুণীরা নির্ধারিত মঞ্চে অবস্থান করে। এ সময় চারদিকে মারমা সঙ্গীতের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ে। তরুণীদের সামনে বিভিন্ন পাত্রে বা জলাধারে জল রাখা থাকে। তরুণরা জলভর্তি পাত্র নিয়ে দলে দলে এসে ‘সাংগ্রাইংতে মিলেমিশে পানি খেলা খেলি ও ভাই সকলে ও বোন সকলে এসো একত্রে আনন্দ করি’। লেঃ লেঃ লেঃ...লেঃ ...মংরো মংরোঃ...মংরো মংরো, পেং পাদাউশে পোওয়াংরে লা সাংগ্রে, ক্যালোঃ মংরো প্যয়ে, (রাঙা পুষ্পশোভিত এ মাসে আত্মহারা হয় সাংগ্রের আনন্দে এই শুভ দিনে তুলনাহীন তুমি, প্যান্ডেলে বসে স্বাগত জ্বানাও, সাংগ্রেং এর জল হীম শীতল সুন্দরী তুমি অপূর্ব) শহরের অলিতে-গলিতে এই ধরনের গান গেয়ে আদিবাসীরা এক অপরকে পানি বর্ষণ করে জলকেলি বা পানি উৎসবে মেতে ওঠে। এসময় বিদেশীরাও পানি খেলায় মেতে ওঠে।
×