ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীঘ্রই সার্কুলার জারি হবে

বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা বন্ধ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা বন্ধ হচ্ছে

রহিম শেখ ॥ প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলমান বিশেষ বিবেচনায় খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এখন থেকে ৫০০ কোটি ও এর বেশি ঋণ রয়েছে এমন বড় বড় শিল্প গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিল বিদ্যমান নীতিমালার আলোকেই করতে হবে। তবে বিশেষ সুবিধা বন্ধ করা হলেও বিদ্যমান পুনঃতফসিল নীতিমালায় কিছুটা শিথিলতা আনার কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যাতে ব্যাংকগুলোকে অনাপত্তি নিতে আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে না হয়। এ বিষয়ে শীঘ্রই ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হতে পারে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, ২০১২ সালের জুন মাসে ঋণ শ্রেণীকরণ, পুনঃতফসিল এবং প্রভিশনের নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ঋণ শ্রেণীকরণে যেমন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, তেমনি পুনঃতফসিলের সুযোগও কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের শেষ সময়ের রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসাবাণিজ্যসহ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সুবিধা দিতে একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট গ্রহণের শর্ত শিথিল ও ঋণের যৌক্তিক মেয়াদ ঠিক করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি নেয়ার শর্ত দেয়া হয়। এই সুবিধা ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত চলমান রাখার নির্দেশনা ছিল। ঐ সময় পর্যন্ত এর আওতায় ৭ শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে খেলাপীর তকমা থেকে রেহাই দেয়া হয়। পরে ৫০০ কোটি ও এর বেশি ঋণ রয়েছে এমন বড় বড় শিল্প গ্রুপের ঋণ পুনর্গঠনে বিশেষ ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সুযোগ নেয় দেশের অন্তত ১২টি শিল্পগ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান। এরপরও রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতির কারণ উল্লেখপূর্বক খেলাপীঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন আসতে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। ফলে দ্বিতীয় ধাপে আরও প্রায় ২ শতাধিক আবেদন বিবেচনায় নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সবমিলিয়ে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ (পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন) নিয়মিত করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও এ সমস্যার সমাধান না হওয়ায় বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল সুবিধা বন্ধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশেষ বিবেচনায় খেলাপীঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা পুরোপুরি বন্ধ করার পদক্ষেপ ইতিবাচক। তবে বিদ্যমান নীতিমালা খুব বেশি শিথিলতা আনলে সব শ্রেণীর গ্রাহকরাই সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। এতে ভবিষ্যতে খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির আরও আশঙ্কা থাকবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি নেয়ার সুযোগ বন্ধ করা করা হলে সব গ্রাহক ঋণ পুনঃতফসিলে সমান সুযোগ পাবেন। কারণ তখন বিদ্যমান নীতিমালার আলোকেই ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনঃতফসিল করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ আবদুর রহিম জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকগুলোর জন্য তার গ্রাহকের ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের একটি নীতিমালা রয়েছে। যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে তারা কোন শ্রেণীর ঋণ, কোন পর্যায়ে, কি পরিমাণ ডাউন্ট পেমেন্টে (এককালীন অর্থ পরিশোধ), কত সময়ের জন্য পুনঃতফসিল করতে পারবে। কিন্তু অনেক সময় গ্রাহকের প্রকৃত অবস্থা বিবেচনায় এই সার্কুলারের বিদ্যমান সুবিধার অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার প্রয়োজন হয়। তখন ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে আবেদন করে। আর এ কাজটি আমাদের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ করে আসছে। নিজস্ব কাজের বাইরে এ কাজটি করতে গিয়ে ঐ বিভাগকে বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। এ কারণে আমরা এ সংক্রান্ত হিসাবগুলোতে আর সুবিধা দিতে চাই না। এজন্য বিদ্যমান পুনঃতফসিল নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন আনা যায় কিনা সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, যাতে ব্যাংকগুলো নিজেরাই কেস টু কেস নিষ্পত্তি করতে পারে। এ বিষয়ে শীঘ্রই একটি সার্কুলার জারি করা হতে পারে বলেও জানান তিনি। বিদ্যমান পুনঃতফসিল নীতিমালা অনুযায়ী, সব ধরনের ঋণের পুনঃতফসিল করার মেয়াদ ও সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করা আছে। ঐ নীতিমালা অনুযায়ী, কোন ঋণ সর্বোচ্চ তিনবারের বেশি পুনঃ তফসিল করা যাবে না। আর এই তিনবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সময়ও নির্ধারণ করে দেয়া আছে। এক্ষেত্রে নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ ঋণের প্রথম পুনঃতফসিল, দ্বিতীয় পুনঃতফসিল ও তৃতীয় পুনঃতফসিলের সর্বোচ্চ সময়সীমা বেধে দেয়া আছে ৩৬ মাস, ২৪ মাস ও ১২ মাস। আর পুনঃতফসিলকৃত ঋণ পরিশোধের সময়সূচী পুনঃতফসিলের দিন থেকে গণনার কথা বলা হয়েছে। তবে স্বল্পমেয়াদী কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে প্রদত্ত সময়সীমার সাথে আরও ৬ মাস যোগ করে পুনঃতফসিলীকৃত ঋণ পরিশোধের সময়সূচী নির্ধারণ করা যাবে। এছাড়া খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিলির জন্য ডাউন পেমেন্টের কিছু শর্ত বেঁধে দেয়া আছে। যেমন মেয়াদী ঋণ প্রথমবার পুনঃ তফসিল করতে গেলে বকেয়া পরিমাণের ১৫ শতাংশ অথবা মোট ঋণের ১০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি, সেটি নগদ পরিশোধ সাপেক্ষে গ্রহণ করা হবে। দ্বিতীয়বার পুনঃ তফসিলের ক্ষেত্রে বকেয়া পরিমাণের ৩০ শতাংশ অথবা মোট ঋণের ২০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি, সেটি নগদ পরিশোধ সাপেক্ষে আবেদন গ্রহণ করা হবে। আর তৃতীয়বারের ক্ষেত্রে বকেয়া পরিমাণের ৫০ শতাংশ অথবা মোট ঋণের ৩০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি, সেটি নগদ পরিশোধ সাপেক্ষে আবেদন গ্রহণ করার কথা বলা আছে। সূত্র বলছে, নতুন সার্কুলারে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সব পর্যায়েই খেলাপীঋণ পুনঃতফসিলের সময়সীমা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হবে। তবে সময়সীমা বাড়ানো হলেও ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।
×