ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গণপরিবহন সঙ্কটের সুরাহা নেই

২ কোটি মানুষের জন্য ১২ হাজার যান

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

২ কোটি মানুষের জন্য ১২ হাজার যান

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর রাজধানী ঢাকা। অথচ পর্যাপ্ত গণপরিবহন নেই। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস, অটোরিক্সা ও ট্যাক্সি সার্ভিস মিলিয়ে অন্তত ৫০ হাজার যানবাহনের প্রয়োজন ঢাকায়। এর মধ্যে ১২ হাজারের কম গণপরিবহন নিয়মিত চলাচল করছে, যা আন্তর্জাতিক কোন মানদ-ের মধ্যেই পড়ে না। এদিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে রাজধানীতে গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ। সঙ্কট সমাধানে সরকারের উদ্যোগ আছে কিন্তু গতি নেই। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালিতে যাচ্ছে সময়। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মধ্যস্থতায় তিন হাজার বাস নামানোর উদ্যোগও আটকে আছে। সব মিলিয়ে গণপরিবহন সঙ্কটে নগরবাসীর জনদুর্ভোগ নিত্যদিনের চিত্র। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে অনুমোদনপ্রাপ্ত বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা সাত হাজারের বেশি। তবে পরিবহন মালিক সমিতির দাবি, সর্বোচ্চ চার থেকে সাড়ে চার হাজার বাস নিয়মিত চলাচলের মধ্যে আছে। প্রায় ১৩ হাজার অটোরিক্সার অনুমোদন রয়েছে। অথচ চলাচল করছে সর্বোচ্চ পাঁচ-ছয় হাজার। টেক্সিক্যাব মাত্র শতাধিক। এই হলো বিশাল এই নগরীর মানুষের জন্য গণপরিবহনের চিত্র। সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদিত রিক্সার সংখ্যা প্রায় ৮৭ হাজার ৮১১। যদিও বেসরকারী নানা হিসাবে এ সংখ্যা আট লাখের বেশি বলা হয়। নগরবাসীর যাতায়াতের এখনও সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো রিক্সা। বাস-ট্যাক্সি ও অটোরিক্সায় যত মানুষ চলাচল করে তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি চলাচল করে রিক্সায়। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, জনসংখ্যার অনুপাতে রাজধানীতে কমপক্ষে ২০ হাজার বাস প্রয়োজন। পাশাপাশি পর্যাপ্ত ট্যাক্সি ও অটোরিক্সার বিকল্প নেই। যানজট, অব্যাহত লোকসান, যন্ত্রপাতিতে মাত্রাতিরিক্ত শুল্কসহ নানা কারণে বাস নামাতে আগ্রহ হারাচ্ছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, নতুন করে বাস নামানো একেবারেই অনিশ্চিত। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে নগরীতে চলা এসি বাস সার্ভিসগুলোও। এদিকে তিন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায় আট হাজার অটোরিক্সা নামানোর প্রক্রিয়া ঝুলে আছে বছরের পর বছর। ভাড়া বেশি, যানজটসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ায় নতুন করে প্রায় এক হাজার ট্যাক্সিক্যাব নামানো হচ্ছে না। যাও নেমেছিল লোকসানের কারণে সেগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। সিদ্ধান্তহীনতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৪০০’র মাত্র বিআরটিসি বাস কেনার প্রক্রিয়াও এগোচ্ছে না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও মালিক সমিতির উদ্যোগে নতুন করে তিন হাজার বাস নামানোর নতুন একটি প্রক্রিয়া শুরু হলেও এক বছরের বেশি সময় এ নিয়ে কোন আলোচনা নেই। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ইতোমধ্যে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। কাজ শেষ হলে নির্ধারিত কোম্পানির পরিচালনায় তিন হাজারের বেশি বাস নামবে ঢাকার রাস্তায়। মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলে ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহন হবে প্রায় ৬০ হাজার। তবে এসব সুবিধা নিশ্চিত হতে অপেক্ষা করতে হবে ছয় থেকে আট বছর পর্যন্ত। সেই সঙ্গে বাস, ট্যাক্সিসহ অটোরিক্সা নামানোর বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া। নতুন বাস নামানোর প্রক্রিয়ায় গতি নেই ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা শহরে মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৬০ লাখ। আশপাশের মিলিয়ে প্রতিদিন প্রাই দুই কোটি মানুষের চলাচল নগরীতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহন সমস্যা নিরসনে সরকারের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ না থাকায় প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বছর দশেক আগে ঢাকার সড়কে বেসরকারী উদ্যোগে প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস নিয়ে এসেছিল ট্রান্স সিলভা লিমিটেড। এখন এসি সার্ভিসগুলো বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাজধানীতে গণপরিবহন সঙ্কট সমাধানে করণীয় প্রসঙ্গে বলেন, ১০০টি এসি বাস ও ২০০টি দোতলা বাস নামানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি কোম্পানিকে বাস নামানোর অনুমতি দেয়ার কথা জানান তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিআরটিসির আরও ১০০ জোড়া বাস ও ২০০ দোতলা বাস আনতে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমতি পেয়েছি। এসব পরিবহন রাস্তায় নামলে গণপরিবহন সঙ্কট অনেকটাই কমে আসবে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে রাজধানীতে চলাফেরা করতে পারবেন বলে জানান তিনি। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে নতুন নতুন বাস নামাতে সরকারীভাবে কোন বাধা নেই। মূল সমস্যা হলো যানজট। যানজটের কারণে অব্যাহত লোকসানের মুখে পরিবহন ব্যবসায়ীরা। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। বিগত তিন-চার বছরে অন্তত ৫০টি পরিবহন কোম্পানি বন্ধ হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, পুরনো কেউ কেউ কিছু বাস নিয়ে আবারও নামার চেষ্টা করলেও শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছেন। প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে এ পরিবহন নেতা বলেন, নগরীর বেশিরভাগ রাস্তা এখন প্রাইভেটকারের দখলে। সঙ্গত কারণে যানজট লেগেই থাকে। বর্তমান অবস্থায় প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ ও রাস্তা দখলমুক্ত করা না গেলে দিন দিন রাজধানীতে চলা বাসগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন ২০ হাজার বাস রাজধানীতে মাত্রাতিরিক্ত যানজট, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল, গাড়ি-যন্ত্রাংশ আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক ও প্রাইভেটকারের কারণেই নতুন নতুন বাস নামাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বেসরকারি খাতের পরিবহন মালিকরা। তারা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে নগর সুরক্ষা ও জনস্বার্থে কঠিন কঠিন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় উদ্যোগ নেয়া হয়। তারা বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে যে এলাকায় বসবাস করেন সে এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের পড়াশোনা করানো বাধ্যতামূলক। ঢাকায় সব ব্যতিক্রম। নামীদামী স্কুলগুলোতে ভর্তির প্রতিযোগিতা। প্রতিটি বিত্তবান শিক্ষার্থীর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে একটি প্রাইভেটকার। এক ভিকারুননিসা নূন স্কুলের তিন ক্যাম্পাসে ১৬ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিদিন রাজধানীতে নামছে অন্তত ১০ হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি। জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, যানজটের কারণে বাস মালিকরা এখন আর গাড়ি চালাতে পারছেন না। নগরীতে প্রায় ২০ হাজার বাসের প্রয়োজন থাকলেও আছে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার হাজার। অথচ বিআরটিএ থেকে অনুমোদন নেয়া আছে সাত হাজারের। তবে গত দুই বছরে অনুমোদিত প্রায় ৮০০ নতুন বাস রাস্তায় নেমেছে। বাস নামানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কাউন্টারের জন্য কোন অনুমোদন নেই, পার্কিং সুবিধা নেই, যানজট, পুরনো গাড়ির রুট পারমিট দেয়া বন্ধ, মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক ধরা হয়েছে। তাই অব্যাহত লোকসানের মুখে গাড়ি ব্যবসা এখন আর ভাল যাচ্ছে না। জনস্বার্থে গণপরিবহন বাড়াতে হলে পার্কিং বে করার পাশাপাশি প্রাইভেটকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে প্রাইভেটকারে সিএনজি সরবরাহ একেবারে বন্ধের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ট্যাক্সি নামানোর সময় মালিকদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে। নতুন বাস নামানো ও পার্টস আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে দিন দিন রাজধানীতে চলা বাসের সংখ্যা আরও কমবে। বাড়বে সঙ্কট। গণপরিবহন সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারোয়ার জাহান বলেন, দেড় কোটির বেশি জনসংখ্যার এ শহরে বাস প্রয়োজন অন্তত ১২ থেকে ১৩ হাজার। এ সংখ্যা বর্তমানে তিন হাজারের মতো। এর প্রধান কারণ সরকার গণপরিবহন নিয়ে মাথা ঘামায় না। ঢাকায় যানজটের কারণে বাস মালিকরাও কাক্সিক্ষত সংখ্যায় ট্রিপ পান না। আর এ কারণে তারাও এ সেবা নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী নন। সড়কে গণপরিবহন হিসেবে বাসের সংখ্যা কমায় ক্রমশ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে বলেও মনে করেন এ নগর পরিকল্পনাবিদ। এটা খুবই স্বাভাবিক। মানুষ চলাচল করবে কিভাবে? গণপরিবহন না থাকলে প্রাইভেট গাড়ি তো বাড়বেই। এতে রাস্তায় যানজট বাড়বে, বলেন তিনি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তথ্যানুসারে, এক হাজার ৫২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকায় সড়ক রয়েছে দুই হাজার ৫৫০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে প্রধান সড়ক ৮৮ কিলোমিটার, যার বেশিরভাগই দখল করে নেয় ব্যক্তিগত যানবাহন। দুই বছর আগের এক হিসাবে দেখা যায়, মোট যানবাহনের মধ্যে ঢাকায় চলাচলকারী মানুষের মাত্র ছয় শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। অথচ এ গাড়িগুলোই সড়কের ৮০ শতাংশ জায়গাজুড়ে থাকে। অটোরিক্সা নামানোর প্রক্রিয়ায় গতি নেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে রাজধানীতে পাঁচ হাজার অটোরিক্সা নামানোর প্রক্রিয়া। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে নতুন নয় হাজার সিএনজি অটোরিক্সা নামানোর কথা ছিল। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে পাঁচ হাজার এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে চার হাজার। বিআরটিএ সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ৬ নবেম্বর চালকদের গণপরিবহন হিসেবে পাঁচ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিক্সার নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে সময় যাচাই-বাছাই করে লাইসেন্স আছে এমন তিন হাজার ১৯৬ জনকে অটোরিক্সার নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু গণপরিবহন হিসেবে নিবন্ধন নেয়া সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে। বিআরটিএ ওই মামলা পরিচালনা না করায় বাধ্য হয়ে ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন সরকারের পক্ষ হয়ে মামলা পরিচালনা করে। ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করে সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি। আপীল নিষ্পত্তি হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। জানতে চাইলে ঢাকা জেলা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন করে অটোরিক্সা নামানো হলে রাজধানীতে পরিবহন সঙ্কট কমে আসত। মালিকরা ইচ্ছামতো চালকদের কাছ থেকে জমা আদায় করতে পারত না। ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকতউল্লাহ বুলু জনকণ্ঠ বলেন, ২০০৮ সালে চালকদের অটোরিক্সা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে দুই হাজার ৬৯৬টি মিশুকের পরিবর্তে অটোরিক্সা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। ইতোমধ্যে ৪০০ নতুন অটোরিক্সা রাস্তায় নেমেছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল আলম খসরু জনকণ্ঠকে বলেন, চালকদের অটোরিক্সা দেয়ার বিষয়টি সরকারের সদিচ্ছার অভাবে আটকে আছে। মন্ত্রণালয় বিআরটিএকে নির্দেশ দিলেই নতুন অটোরিক্সা রাস্তায় নামতে পারে বলে জানান তিনি।
×