ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

বিশ্ব ভারতীতে একদিন এবং কলকাতার আন্তর্জাতিক সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

বিশ্ব ভারতীতে একদিন এবং কলকাতার আন্তর্জাতিক সম্মেলন

বাংলাদেশের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব ভারতী বাঙালিত্বের প্রতীক। সম্প্রতি ভারতের ফরিদাবাদ ও কলকাতা একই দিনে দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত কলকাতায় সম্মেলনে সপরিবারে যাওয়াই মনস্থ করলাম। আমার দুটো প্রবন্ধ উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সামাজিক যোগাযোগ কেননা কলকাতায় কয়েকবার গেলেও আরও অধিক সময় ধরে দেখার ইচ্ছে ছিল। ভাগ্যের ফের বলতে হবে, কনফারেন্স ভিসার জন্য এ্যাপ্লাই করলে আমাকে আর আমার স্ত্রীকে নব্বই দিনের জন্য পর্যটক হিসেবে ভিসা দিয়েছে, অন্যদিকে আমার ছেলেকে এক মাসের জন্য অর্থাৎ কনফারেন্সের প্রথম দিন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। যে প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য ট্রেনে যাওয়ার বাসনা করেছিলাম তা ভিসাপ্রাপ্তির পর ভেস্তে গেল। আগেরবার আমার ছেলে যখন ব্যাঙ্গালুরু এমটিসি গ্লোবাল কর্তৃক পুরস্কার পেয়েছিল তখন কিন্তু নব্বই দিনের জন্য ভিসা দিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে প্রকৃতি দেখার ইচ্ছে উধাও হয়ে গেল। ট্র্যাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে যখন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে কিংবা এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে আসা-যাওয়ার কথা বলল তখন কোনটাই মনোপূত হলো না। দু’বার বাংলাদেশ বিমানের ৩-৪ ঘণ্টা করে বিলম্বে যে দুর্গতি পোহাতে হয়েছে তা কহতব্য নয়। আর নির্দিষ্ট সময়ের আগে এয়ার ইন্ডিয়ার বোর্ডিং শেষ করায় প্লেন মিস করার যে দুর্গতি এবং সেটি জানানোর পরও কোন আনুষ্ঠানিক জবাব পাইনি। শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেটে দেখলাম নভো এয়ারে গেলে অন্তত উদ্বোধনী দিনে অংশ নিয়ে ফেরা যাবে। অগত্যা আর কি করা। ইতোপূর্বে ভারতে গেলেও বিশ্ব ভারতীতে যাওয়া হয়নি। ভাবলাম যাচ্ছি যখন তখন ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের সঙ্গে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনরূপ সুদূরপ্রসারী সমঝোতা করা যায় কিনা সে ব্যাপারে উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধ করলাম। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মহোদয় প্রফেসর ড. স্বপন কুমার দত্ত ৬ এপ্রিল বিকেল তিনটায় সময় দিলেন। সমস্যা হলো সল্ট লেকের যে গেস্ট হাউসে উঠেছি উনাদের ঠিক বিশ্ব ভারতী সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। শান্তি নিকেতনের কথা বলাতে রক্ষাÑ বললেন, বোলপুরে যেতে হবে সড়কপথে ১৬৬ কিলোমিটারের বেশি। আরেকটি উপায় সকাল ৬টায় ট্রেন ছেড়ে যায়। এত সকালে স্টেশনে যাওয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। বরং ভোরবেলার বদলে একটু সময় নিয়ে সড়কপথে রওনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ট্যাক্সি ঠিক করে দিল। কিন্তু ড্রাইভার ভুল পথে গিয়ে বিপত্তি ঘটাল। বিকেল তিনটার বদলে পাঁচটায় গিয়ে পৌঁছলাম। ভাবলাম ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের জার্নাল, নিউজ লেটার আর আমার লেখা দুটো বই উপাচার্যের কোয়ার্টারে পৌঁছে দেই। কিন্তু বাদ সাধল আমার স্ত্রী এবং ছেলে। এত দূর থেকে এসেছি দেখা করে যাওয়া উচিত। উপাচার্য কোয়ার্টারে গিয়ে দেখলাম সেখানে উপ-উপাচর্য থাকেন। আর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য রতন পল্লীতে থাকেন। এমন সময় দেখা হলো একজন প্রবীণ ও প্রাক্তন রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপকের সঙ্গে। বেশ রসিক, আমুদে এবং অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি। তিনি বললেন, আমিও রতন পল্লীতে থাকি। সেখানে উপাচার্য যেখানে থাকেন সেখানে আমার গাড়ির পেছন পেছন আসুন। আমরা তার গাড়ি ফলো করে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মহোদয়ের বাসার সামনে এসে পৌঁছলাম। দারোয়ান জানালেন ৭-৮টার আগে উনার কার্যালয় থেকে আসেন না। এর মধ্যে মি. দত্তের স্ত্রী অধ্যাপক ড. লীনা যখন শুনলেন যে, আমরা ঢাকা থেকে গিয়েছি, ভদ্রমহিলা তখন গাড়িতে বসে ছিলেন। তিনি নামলেন, আমার পরিচয় জানলেন। তিনি এক পর্যায়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেললেন। বললেন তার জন্ম ঢাকায়। জন্মস্থানের কথা স্মরণ করে সন্ধ্যার আলোয় নিজেকে বড় অপরাধী মনে হলো। দেশ ভাগের যাতনা যে কি ভয়ঙ্কর সে মুহূর্তে প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম। লজ্জায়-সঙ্কোচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ অথচ এখনও জন্মস্থানের কথা ভুলতে পারেননি। জীবনে যশ-খ্যাতি কম পাননি; কিন্তু মাতৃভূমি সে যে ভিন্ন স্বাদের- ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদাগী গরিয়সী।’ ভাবলাম আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেও কিছু কুলাঙ্গার তথাকথিত নব্য জেএমবির নামে পাকিস্তান ও সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন করে চলেছে। এদের তো এদেশে না থেকে বরং পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের পদচারণায় ধন্য বিশ্ব ভারতী এখনও সম্পূর্ণভাবে যান্ত্রিক কোলাহলে পূর্ণ হয়নি, বরং প্রকৃতির সুমধুর আবহাওয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। প্রকৃতির নিবিড়তায় সন্ধ্যায় আলোগুলো যেন সুন্দর ও মহত্ত্বের কথা বলছে। ছোট টেম্পোগুলো ক্যাম্পাস ভ্রমণের আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বিধা-সঙ্কোচ নিয়েই উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। উনার পা-িত্য, জ্ঞান, নিরহঙ্কার আচরণ মুহূর্তে আপন করে নিলেন। স্বল্পভাষী ব্যক্তি হলেও আশ্চর্য ঋজুতায় তার বক্তব্য বেশ ভাস্বর। আমরা সেদিন চলে আসব শুনে উনি অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করল। কৃষি বিজ্ঞানী ও বায়োটেকনোলজিতে তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিময় গবেষণা এবং বিদেশে অধ্যাপনার কথা শুনলাম। জানতে পারলাম তার আদি বাড়িও বাংলাদেশে। স্কুল জীবন কেটেছে এ বঙ্গে। উনাকে অনুরোধ জানালাম, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের সঙ্গে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কোন সমঝোতা স্মারক করা যায় কিনা সেটির জন্য অর্থনীতি বিভাগকে অনুরোধ করতে। পাশাপাশি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের নেতৃত্বে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্সটিটিউট ইনস্টিটিউট হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এ দেশে পেশাদার অর্থনীতিবিদ তৈরির প্রয়াস নিয়েছেন। তার চিন্তা-ভাবনার সফল বাস্তবায়নে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ কাজ করে চলেছেন। তবে আশা করা যায় এমফিল এবং পিএইচডির গবেষণার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলটিকে অনুমোদন দিলে এ অগ্রযাত্রা দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা করবে। কেননা দেশে পেশাদার অর্থনীতিবিদের অভাব রয়েছে। সরকারী আমলা, ব্যাংকার, উন্নয়ন কর্মী, শিক্ষকরা লাভবান হবেন। যারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের জন্য সুযোগ পেলে তারা তাদের পেশায় দায়িত্বের সঙ্গে বিকাশ ঘটাতে পারেন। উনার সঙ্গে আলোচনা শেষে যতটুকু সম্ভব সন্ধ্যায় ঘুরে ঘুরে বিশ্ব ভারতী দেখতে দেখতে নিজেকে মনে হলো প্রকৃতির সুন্দর সুষমা এবং যান্ত্রিক কোলাহলমুক্ত পরিবেশে অধ্যয়নের যে চিন্তা, মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার মাধ্যমে যে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, চাকরিপ্রার্থী নয়, বরং বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন, গবেষণার জন্য একটি আদর্শ স্থান এবং সমাজ উন্নয়ন ভাবনাকে বিশ্ব ভারতী তা সুন্দরভাবে গ্রথিত ও বিমূর্ত করে তুলছে। রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন যে, উচ্চশিক্ষা কেবল তথ্য প্রদান করে না বরং আমাদের জীবনকে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের সুযোগ করে দেয়। আজ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় যুগে এসেও আমরা রবীন্দ্রনাথের পথ দেখালে সে পথেই উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করার প্রয়াস নিচ্ছি” যা শিক্ষার আধুনিকায়নের নামে বলা হচ্ছেÑ তা তক্ষশীলা ও নালন্দা বিহারে বহু পূর্বে চর্চিত হতোÑ রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব ভারতীতে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর রোপিত বৃক্ষ আজ ফুল-ফল-পুষ্পে শোভিত হয়ে উঠছে। তাঁর রোপিত বীজ আজ ছড়িয়ে দিচ্ছে আলো। আমরা বাংলাদেশীরা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করি। তাঁর রচিত জাতীয় সঙ্গীত আমাদের মেধা-মনন, অন্তরজুড়ে বহমান। আর তাই তো এদেশে বাঙালী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন প্রতিটি বাঙালীর অন্তর্লীন সত্তায় রবীন্দ্রনাথ প্রবহমান থাকবেন। চলবে...
×