ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় বঙ্গাব্দ ১৪২৩

চৈত্রসংক্রান্তি- বর্ণাঢ্য আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৪ এপ্রিল ২০১৭

চৈত্রসংক্রান্তি- বর্ণাঢ্য আয়োজন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নদীর স্রোতের মতোই সময় বহমান। সেই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে শেষ হলো আরও একটি বাংলা বছর। আগামীর পথে ছুটে চলার প্রত্যয়ে মহাকালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল বঙ্গাব্দ ১৪২৩। সেই সূত্রে বৃহস্পতিবার ছিল বিগত বাংলা বছরের শেষ দিন ত্রিশে চৈত্র। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সংস্কৃতির রীতিমাফিক চৈত্রসংক্রান্তি। এক সময়কার গ্রামীণ এই লোকাচার এখন ঠাঁই করে নিয়েছে শহুরে নাগরিক জীবনে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বাংলা সনের সমাপনী মাস চৈত্রের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে বাঙালীর রয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। কালক্রমে ধর্মভিত্তিক আচার থেকে উৎসবে রূপ পাওয়া দিনটিকে ঘিরে রাজধানীতে ছিল নানা আয়োজন। পুরনো বছরের জীর্ণতাকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরের প্রাপ্তির প্রত্যাশা উঠে আসে সেসব আয়োজনে। শেকড় সন্ধানী নাগরিক মন ঐতিহ্যের আবাহনে শামিল হয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপনে। চৈত্রসংক্রান্তিতে ঢাকার নানা প্রান্তে সংস্কৃতি অঙ্গনে ছিল উৎসবমুখর রকমারি বর্ণিল আয়োজন। পুরনো বছরের শেষ সন্ধ্যায় নাচ-গান, কবিতা ও কথায় সাজানো ছিল এসব অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত চত্বরে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে যৌথভাবে চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজন করে সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে চৈত্রসংক্রান্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। বাংলা বছরের শেষ দিনকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের চারু শিক্ষার্থীদেরও ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের রাজপথে বছরের বিদায়ী দিনে রঙের খেলায় আঁকা হয়েছে আলপনা। শিল্পকরা একাডেমিতে ছিল লাঠিখেলা, ঘুড়ি ওড়ানোসহ নানা কিছু। সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের আয়োজন রাজধানীর চৈত্রসংক্রান্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানটি হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। যৌথভাবে ষষ্ঠবারের মতো বর্ষবিদায়ের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সঙ্গীত সংগঠন সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। বর্ষবিদায় অনুষ্ঠানে সুরের ধারার শিল্পীরা পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের গান। ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীতনির্ভর নৃত্য ও কবিতা আবৃত্তি। ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ’ প্রতিপাদ্যে সাজানো হয় বর্ষবিদায়ের এ অনুষ্ঠান। বছরের শেষ দিনটির সূর্যাস্তের সঙ্গে শুরু হয় চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজন। শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত ছবি দিয়ে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। এরপর সুরের ধারার ৪০ জন শিক্ষক-শিল্পীকে নিয়ে চারটি গানের একটি মেলোডি পরিবেশন করেন সুরের ধারার চেয়ারম্যান ও রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। গানগুলো হলোÑ ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’, ‘গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর’, ‘চিত্ত পিপাসিত রে গীতসুধার তরে’ ও ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে’। গান শেষে চৈত্রসংক্রান্তি কথনে অংশ নিয়ে আয়োজনের নানা দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এছাড়া অনুষ্ঠানে গানের ফাঁকে ফাঁকে চৈত্রসংক্রান্তি কথনে অংশ নেন বিশিষ্টজনরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরসহ বেশ কয়েকজন অতিথি। অনুষ্ঠানে সুরের ধারার শিশু বিভাগের প্রথমবর্ষ ও প্রারম্ভিকের শিশুদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় তিনটি গানÑ ‘মৌমাছিদের ঘর ছাড়া করল কে’, ‘সব কাজে হাত লাগাই মোরা’ ও ‘যিনি সকল কাজের কাজী’। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ থিমের ওপর ভিত্তি করে আলাদা আলাদ সাজানো ‘জীবনদেবতা’, ‘রাগে রঙে রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবি বাউল’, ‘কাল মৃগয়া’, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান’, ‘ছিন্নপত্র’ পর্বে সুরের ধারার শিল্পীদের পাশাপাশি গান ও কবিতা আবৃত্তি পরিবেশন করেন অতিথি শিল্পী মহাদেব ঘোষ, বুলবুল ইসলাম, মিতা হক, রোকাইয়া হাসিনা প্রমুখ। রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে পাঠ করেন অপি করিম। ছিল রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার পরিচালনায় ‘অচলায়তন’ নাটকের পরিবেশনা। এ নাটকে একটি নাচে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী-শিল্পীরা। সুরের ধারা তাদের প্রথা অনুযায়ী রাত ১২টা এক মিনিটে ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলো’ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বর্ষবিদায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন। এর আগে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা একক কণ্ঠে গেয়ে শোনান ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে’। আয়োজন শেষে নতুন বর্ষকে স্বাগত জানিয়ে সুরের ধারার শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘এসো হে বৈশাখ’। একই ভেন্যুতে রাত সাড়ে ১২টা থেকে ছিল বাউল গানের আসর। বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে চ্যানেল আই। বিদায়ী দিনে আলপনা উৎসব রাজধানীর পিচঢালা কালো পথে চলল শিল্পীর রং-তুলির আঁচড়। রঙের ওপর রং চাপিয়ে বর্ণিল হলো সেই রাজপথ। আঁকা হলো রকমারি নক্সার আলপনা। উঠে এলো আবহমান বাংলার সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পীর সঙ্গে দুই শতাধিক তরুণ চারু শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ মিলেমিশে একযোগে আঁকলেন চার লাখ বর্গফুটের দীর্ঘ আলপনা। বর্ণিল আলপনায় পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে স্বাগত জানানো হলো নতুন বছরকে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বাংলালিংক, এশিয়াটিক ইএক্সপি ও বার্জার পেইন্টস লিমিটেডের সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ‘আলপনায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক উৎসব। সেখানেই দেখা মিলল চমৎকার এ দৃশ্যের। বৃহস্পতিবার রাতে যৌথভাবে এ উৎসব উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, বাংলালিংকের চীফ কর্পোরেট এ্যান্ড রেগুলেটরি এ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান, এশিয়াটিক ৩৬০-এর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারপার্সন সারা জাকের, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং) একেএম সাদেক নাওয়াজ। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজাসংলগ্ন অংশে স্থাপন করা হয় বড় বড় এলইডি পর্দা। মাঝখানে মঞ্চ। এক পাশে ছিল এর আগের আয়োজনগুলোর আলোকচিত্র প্রদর্শনী। পথে রঙিন আলপনা অঙ্কন, তার সঙ্গে মঞ্চে ছিল চিরকুট ব্যান্ড দলের গান। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ। আলপনা আঁকা-আঁকির পাশাপাশি এ আয়োজনে ছিল বাঙালী খাবারের স্টল, ফেস পেইন্টিংসহ নানা আয়োজন। উৎসবমুখর পরিবেশকে বর্ণিল করতে ছিল মুগ্ধকর লেজার শো। ছিল ফটো কনটেস্ট। এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা ফেসবুকে ছবি আপলোড করে এ কনটেস্টে অংশ নেন। এবারই প্রথম ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ ছাড়াও চট্টগ্রামের ডিসি হিল, রাজশাহীর পদ্মার পাড়, খুলনার শিববাড়ি চত্বর, বরিশালের বঙ্গবন্ধু পার্ক রোড এবং ময়মনসিংহের টাউন হল চত্বরে এ আলপনা উৎসবের আয়োজন করা হয়। শিল্পকলা একাডেমির চৈত্রসংক্রান্তি নববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দুই দিনের অনুষ্ঠানমালায় বৃহস্পতিবার ছিল চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজন। বিকেলে একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে উড়িয়ে দেয়া হয় রঙ্গিলা ঘুড়ি। একাডেমির ভবনসমূহের ছাদে পুরান ঢাকার ঘুড়িবাজ জয়ের নেতৃত্বে কুড়ি সদস্যের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় এ ঘুড়ি উৎসব। একই সময়ে শুরু হয় একাডেমি প্রাঙ্গণে মানিকগঞ্জের মনিরের নেতৃত্বে নাগরদোলা ও বায়োস্কোপ। এছাড়াও একাডেমি প্রাঙ্গণে ছিল সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, মানি মিয়ার চাঁপাই গম্ভীরা, জসীম পাগলা ও তার দলের পরিবেশনায় ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ পালাগান এবং ঐতিহ্যবাহী রায়বেশে নৃত্য। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন প্রতিবারের মতো এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন করে। শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত এ আয়োজন শুরু হয় মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানমালায় ছিল মুড়ি-মুড়কি বিতরণ। সাংস্কৃতিক পর্বে সরোদে সুর ছড়িয়েছেন ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খান। ময়মনসিংহের জসীম পাগলা ও তার দলের পরিবেশনায় ছিল ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ পালা। চাঁপাই গম্ভীরা দল পরিবেশন করে গম্ভীরা গান। এছাড়াও ছিল পুঁথিপাঠের আসর। রবিরাগের আয়োজন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়েছে রবীন্দ্র সঙ্গীত সংগঠন রবিরাগ। শাহবাগের সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে সাজানো হয় আয়োজন। ‘আঁকবো আমরা রাঙাবো গেন্ডারিয়া’ পুরান ঢাকার গে-ারিয়ার সীমান্ত খেলাঘর আসর ও সীমান্ত গ্রন্থাগার যৌথভাবে বৃহস্পতিবার ‘আঁকবো আমরা রাঙাবো গেন্ডারিয়া’ প্রতিপাদ্যে আলপনা উৎসবের আয়োজন করে। সীমান্ত গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণের মূল রাস্তা থেকে আজগর আলী হাসপাতাল পর্যন্ত পুরো এলাকায় আলপনা আঁকা হয়। সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, সংস্কৃতিজন মানজার চৌধুরী সুইট, সীমান্ত গ্রন্থাগারের সভাপতি মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক কাজী সুলতান আহমেদ টোকন প্রমুখ।
×