ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

তেতো খাওয়া ॥ চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৪ এপ্রিল ২০১৭

তেতো খাওয়া ॥ চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ

আজ শুক্রবার, পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম-দিন। নববর্ষ সরকারীভাবে উদযাপিত হচ্ছে সারাদেশে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এবার বৈশাখী ছুটির আনন্দটা পাওয়া গেল না। এতে কী? সরকারী ও বেসরকারীভাবে দিনটি উদযাপিত হচ্ছে তাই তো বড় ঘটনা। অবশ্য একটা কথা আছে। যারা ‘পঞ্জিকা’ মতে নববর্ষ করবেন তারা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবেন আগামীকাল শনিবার। এই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের (বাংলা) বাঙালীরা নববর্ষ পালন করবেন আগামীকাল। আমাদের দেশেরও বিপুল জনগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখ পালন করবেন দুইদিন- একদিন সরকারী মতে, অন্যদিন পঞ্জিকা মতে। ভালই হলো, বিনা আপত্তিতে বাঙালীর নববর্ষের শুরুর দিন হয়ে গেল দুইদিন- প্রতিবছর। একটি সরকারী মতে অর্থাৎ বাংলা একাডেমির মতে, অন্যটি পঞ্জিকা মতে। বাঙালীর জীবনের এই বিভক্তি নিয়ে কিন্তু কেউ আলোচনা করে না। অবশ্য আজকাল অনেক জ্বলন্ত বিষয় নিয়েও কোন আলোচনা নেই। ‘গয়ং গচ্ছ’ ভাব সর্বত্র। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পলায়নরত- তাই নয় কী? সে যাই হোক, আমাদের অনেকের হিসেবে বাইরেও পয়লা বৈশাখ পালিত হয় বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে। কোন হৈচৈ নেই। হৈচৈ হয় আনুষ্ঠানিকতার, করে মিডিয়া- বেশ অনেকটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই। বৈচিত্র্যময় পহেলা বৈশাখ যদি যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হতো তাহলে দেখা যেত এই বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয় নববর্ষের পহেলা দিনের দুইদিন আগে থেকেই। এটা যেমন করে পাহাড়ী অঞ্চলের আদিবাসীরা, তেমনি করে সমতলের বিপুলসংখ্যক বাঙালী। ‘বাংলা নামের’ ওই লোকদের পহেলা বৈশাখ শুরু হয়েছে এবার বৃহস্পতিবার। এই দিন তেতো খাওয়ার দিন। ‘গিমা’ শাক, নিমপাতা, ভেদালিয়া পাতা, উচ্ছে জাতীয় তেতো খাওয়া হয় এই দিন। আমার মনে আছে চৈত্রের শেষে এই দিন ঠাকুর মা আমাদের নাক বন্ধ করে তেতো খাওয়াতেন। কারণ, আমরা বাচ্চারা তেতো খেতাম না। এর আগে অবশ্যই ঘর ‘ঝাড়মোছ’, যে চলত কয়েকদিন ধরে। হাঁড়ি-পাতিল, ধোয়ামোছা, ঘরদোর সাফ করা, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করার পরই তেতো খাওয়ার দিন। পরের দিন যায় চৈত্র সংক্রান্তিতে। নিরামিষ খাওয়া হয় ওইদিন। তৃতীয় দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ খাওয়া হতো মাছ-মাংস, ভাল খাবার। ইলিশ? না, ইলিশের কোন ব্যাপার আমাদের ছোটবেলায় ছিল না। ইলিশের সঙ্গে পান্তাভাত সে তো ঢাকায় দেখছি। এসব উদীয়মান অর্থনীতির ঘটনা। যেটা হতো সেটা হচ্ছে ‘রসগোল্লা’ খাওয়া। তা কিন্তু গ্রামে নয়। গঞ্জে-বাজারে। মহাজনরা খাওয়াতেন মিষ্টি। মিষ্টির আয়োজন হতো ব্যবসায়ীদের জন্য। বড় বাজারের দোকানদাররা অধিকাংশই ছিলেন পাইকারি ব্যবসায়ী। গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট খুচরা ব্যবসায়ী। সারা বছর মহাজনের সঙ্গে ব্যবসা। ‘মহাজন’ মানে ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের ‘সাধু’ও বলা হতো। ‘সাধু’ থেকে ‘সাহু’, ‘সাহু’ থেকে ‘সাহা’ যা বাঙালী ব্যবসায়ীদের একটা পদবি। সারা বছর ব্যবসা, আছে স্ট্রেড-ক্রেডিটের ব্যবস্থা। লেনদেন। নগদে-বাকিতে চলছে ব্যবসা। বছর শেষে যেটুকু ‘বাকি’ (ক্রেডিট) থাকত তা পরিশোধ করত ব্যবসায়ীরা। ওইদিন ছিল হালখাতা। লাল রঙের খাতা। হালখাতার দিন বছরের হিসাব ‘ক্লোজ’ করতে হতো। নতুন বছরে নতুন হিসাব। পুরনো হিসাব ‘ক্লোজড’। মহাজনের খাতা পরিষ্কার। বছরের দেনা-পাওনা শেষ। ‘জের’ টানা হতো না। ‘ক্যাশ মেথডে’ ‘এ্যাকাউন্টস’ হতো রক্ষণ। বড়ই মজার বিষয়, শিক্ষণীয় বিষয়। সেই ‘ক্যাশ মেথডে’র হিসাবই আমরা বিদেশ থেকে ধার করে এনেছি ব্যাংকিংয়ে যার জন্য এত হৈচৈ। ব্যাংকগুলো আগে ‘এক্সুয়েল সিস্টেম’-এ হিসাব রাখত। সারা বছর ব্যবসা। বছর শেষে যা ‘বাকি’ থাকত তা ‘ব্যালেন্স’ থাকত। ‘ব্যালেন্স ক্যারিড ফরওয়ার্ড’ এবং ‘ব্যালেন্স ব্রট ফরওয়ার্ড’ করে হিসাব রাখা হতো। অর্থাৎ পুরনো জঞ্জাল থেকেই যেত ‘জের’ হিসাবে। এখন ব্যাংক এই ‘এক্সুয়েল সিস্টেম’ বাদ দিয়ে ‘ক্যাশ সিস্টেমে’ এসেছে। বছরের হিসাব বছরে। ছয় মাস ব্যাংকের দেনা কেউ পরিশোধ না করলেই ব্যাংক একে ‘ক্লাসিফাইড লোন’ হিসেবে গণ্য করে আলাদা ‘লেজারে’ (খাতা) নিয়ে যায়। ‘জের’ টানে না। এর ওপর সুদ হিসাব করে কিন্তু ‘প্রফিটে’ যোগ করা হয় না। আদায় হলে পরে প্রফিটে যায়। বোঝাই যাচ্ছে বাঙালীর এ্যাকাউন্টিং বিশ্ব গ্রহণ করেছে। পহেলা বৈশাখের কত আলোচনা, অনুষ্ঠানের আলোচনা, নিরাপত্তার আলোচনা, গায়কদের ছবি ও হাজারজনের গান গাওয়ার আলোচনা, কৈ বাঙালীর হিসাবের এই দিকটার আলোচনা তো কেউ করে না। ‘হালখাতা’ যে হালখাতা নয়, হালখাতা যে লালখাতা নয়, তা যে এ্যাকাউন্টিংয়ের একটা বিশেষ পদ্ধতি তা নিয়ে কেউ আলোচনা করে না। বরং উল্টো এটিকে বিশেষ একটা জনগোষ্ঠীর বিষয় এভাবে দেখা হয়। যা নিতান্তই ভুল। চৈত্র মাসে ‘তিতা’ খাওয়াÑ এর মধ্যে তো কোন না কোন কারণ আছে। এ মাসেই বসন্ত ইত্যাদি রোগ হয়। শুনেছি তেতো না কি এই রোগের প্রতিষেধক। যদি তা সত্যি হয় তাহলে সবাই মিলে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ‘তেতো’ খাই না কেন? কোথাও যেন কী বাধা কাজ করে এসবে। এটাই কী বাঙালীর ক্ষেত্রে দুইটা ‘পহেলা বৈশাখ’ হওয়ার কারণ? জানি না প্রকৃত কারণ কী? পৃথিবীর অন্য কোন ভাষাগোষ্ঠীর লোকদের নববর্ষ কী এরকম দুইদিন তিন দিনে পড়ে? বিশেষজ্ঞরা একটা ধারণা দিলে শান্তি পাই। পহেলা বৈশাখে পাহাড়ে কিন্তু নানা উৎসব হচ্ছে। ওখানে কে জানি চালু করেছে ‘বৈসাবী।’ ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মার্মাদের ‘সাংগ্রাই’ এবং তৈঞ্চঙ্গাদের ‘বিষু’- এই তিনের আদ্যাক্ষর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘বৈসাবী’ যা পাহাড়ের অন্যান্য আদিবাসী মানতে রাজি নয়। সে যাই হোক, সেখানেও দেখা যাচ্ছে বছরের প্রথম দিনের আগে আরও দুইদিন নানা উৎসব আছে। তাদের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে অনেকাংশে মিল আছে সমতলের বাংলা নামধারীদের উৎসবের। ঐতিহাসিকভাবে এরা কী তাহলে একই সূত্রে গাঁথা ছিল? জানি না, এর উত্তর আমার কাছে নেই। তবে পহেলা বৈশাখের নানা অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছে সারাদেশে বস্তুত তিনদিন ধরে পালিত হচ্ছে। মেলার হিসাব ধরলে তা চলে অনেকদিন। এর মধ্যে ‘শৈবদের’ হিসাব করলে পুরো চৈত্র মাসই নানা অনুষ্ঠানে ভর্তি, যা শেষ হয় ‘চড়ক পূজায়’। ঐতিহাসিকভাবে তা বৌদ্ধদের ‘ধর্মচক্র’ বলেই ধারণা করা হয়। এভাবে দেখলে চৈত্র মাস শেষে যে পহেলা বৈশাখ আসে তা নিয়ে বাঙালীর আনন্দের সীমা নেই। আমাদের ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ফসলের কোন সম্পর্ক ছিল না। তখন ছিল দুই ধানী ফসল- আউশ ও আমন। আষাঢ়-শ্রাবণে আউশ, পৌষ মাসে আমন। এখানে ফসলের যোগাযোগ বৈশাখের সঙ্গে কোথায়? অথচ ধারণা করা হয় পহেলা বৈশাখে সরকারের রাজস্ব পরিশোধ করা হতো। ফসল না হলে রাজস্ব দেয়া-নেয়া কীভাবে? বোঝা যায় এতেও বিবর্তন ঘটেছে। এখন অবশ্য বৈশাখে বোরো ধান ঘরে আসে। এটা এখন প্রধান ফসল। অতএব, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ খুবই ব্যাপক হওয়ার কথা। কারণ অর্থের যোগাযোগ ঘটে পহেলা বৈশাখে, বৈশাখ মাসে। শত হোক অর্থের সঙ্গে পালা-পার্বণ-উৎসবের সম্পর্ক নিবিড়। ফুলের ব্যবহার ও বেচা-কেনা, মিষ্টির ব্যবহার ও বেচা-কেনা, জামা-কাপড়ের বেচা-কেনার হিড়িক দেখে মনে হয় বৈশাখ হয়ে উঠছে একটা সর্বজনীন উৎসব, যদিও এতে বাধা দেয়ার শক্তিও প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। এখন পহেলা বৈশাখকে উপলক্ষ করে অনেক অনুষ্ঠান হয়। ছায়ানটের বর্ষবরণ-সূর্যোদয়ের পূর্বে, ‘হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ’ আরেকটি উৎসব। সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব হচ্ছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। যতই দিন যাচ্ছে ততই নতুন নতুন অনুষ্ঠান যোগ হচ্ছে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে। এতে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। আবহমান বাংলায় কুটির শিল্পের ও হস্তশিল্পের তৈরি পণ্যাদি ছিল বৈশাখী মেলার আকর্ষণ। ছিল শাড়ির বেচা-কেনা, তাঁতীদের কিছু ব্যবসা। এখন বুটির হাউসগুলোর রমরমা ব্যবসা হচ্ছে। শপিং মলগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। শাড়ি, পাঞ্জাবি, তাগা, সালোয়ার-কামিজ ও ফতুয়ার ঘটছে প্রসার। ওড়না, ব্লাউজ ও কোর্তা চলছে পাশাপাশি। মসলিন হাফসিল্ক, এ্যান্ডি ইত্যাদির কদরও বাড়ছে। চারদিকে যে উৎসবমুখর পরিবেশ তাতে সরকার মদদ যোগাচ্ছে বাজারে। পহেলা বৈশাখে সরকার দিচ্ছে বোনাস, যা বাজারে ‘ক্যাশ’ সরবরাহ করছে। এ মাসে কী ‘রেমিটেন্স’ বৃদ্ধি পায়? দুই ঈদে কোটিখানেক ওয়েজ আর্নার দেশে অধিকতর রেমিটেন্স পাঠায়, যা ঈদে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। বৈশাখে কী এটা ঘটে? ঘটলে দারুণ ব্যাপার হতো। গ্রাম-গঞ্জের অর্থনীতি বৈশাখকে কেন্দ্র করে আরও বেশি উজ্জীবিত হতো। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও বাড়ত। এর পরেও পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠানাদি বৈচিত্র্যময় হচ্ছে প্রবল বাধাবিপত্তির মুখেও। ভাবা যায় বাঙালীর নববর্ষ উদযাপনে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকতে হবে রাজধানী শহরকে! কেন পহেলা বৈশাখ ‘অনিরাপদ’ হচ্ছে? কোন্ শক্তি বাঙালিত্বকে বাধাগ্রস্ত করছে? ২০২৪ বাংলা নববর্ষে এই হচ্ছে আরেক দিক, যা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×