বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আমি ধর্ম পালন করি, ধর্ম মান্য করি। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করি না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বিএনপি ও খালেদা জিয়ারাই করেন। ধর্মকে তারাই ব্যবহার করেন। মুখে বিসমিল্লাহ বলে দুনিয়ার মিথ্যা কথা বলে বেড়ান, মানুষের ক্ষতি করেন। খালেদা জিয়ার মতো আমি চুপকে চুপকে কোন চুক্তি করিনি। এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে অবহিত করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়েছে। কেউ চোখ থাকতে তা না দেখলে তাদের কপাল মন্দ।
বুধবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে ‘হাসিনা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন’- খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বায়বীয়’- খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যে ব্যাখ্যা দাবি করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বায়বীয় নয়, খালেদা জিয়ার বক্তব্যই বায়বীয়। এর আগে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর, তারও আগে মনমোহন সিং সফর করে গেলেন, ভারতীয় সংসদে ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তি অনুমোদিত হলো, কার্যকর হলো- এসব কী তাহলে বায়বীয়? বায়বীয় বলতে খালেদা কি বোঝাচ্ছেন তার ব্যাখ্যাটা জাতির কাছে দেন।
কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদান সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, এই বিএনপি-জামায়াতই বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দিয়ে শত শত কোরান শরীফ পুড়িয়েছে। মানুষ হত্যা করা, পুড়িয়ে মারা, গাছ কেটে ফেলা, জাতির সম্পদ নষ্ট করা এগুলো কোন ধর্ম পালন? আসলে ধর্মকে তারাই ব্যবহার করে। আজকে আমরা কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছি বলেই ওনার গায়ে জ্বালা ধরে গেছে। এই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত যাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন না হয় সেজন্যই আমি সরকারে আসার পরই আলেম-ওলামাদের নিয়ে দীর্ঘদিন বৈঠকের পর এখন তারা একটা সমঝোতায় এসেছে। এখানে খালেদা জিয়ার দুঃখটা কীসের?
খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থাকতে কেন তিস্তার পানি আনতে পারেননি? আগে জাতির কাছে সেই জবাব দিন। ভারতের খোশামদি, তোষামদিতে এমনই ব্যস্ত ছিল যে পানি চাওয়ার সাহসও তাঁর ছিল না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বলেছেন, তাঁর ভারত সফরে দেশবাসী না-কি কিছুই পায়নি। এই সফরকালে চুক্তি ও সমঝোতা অনুযায়ী ভারত থেকে যে গ্যাস, এলএনজি ও বিদ্যুত আসবে তা কী আমি একাই ভোগ করব, নাকি দেশবাসীরও কাজে লাগবে? বরং খালেদা জিয়ার কাছে প্রশ্ন- ক্ষমতায় থাকতে তিনি তিস্তা চুক্তির বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেননি কেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যের পর সাংগঠনিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকের শুরুতেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। বৈঠকে বিভিন্ন দিবসের দলীয় কর্মসূচী চূড়ান্ত করা হয়। তবে বৈঠকের পুরো আলোচনাতেই সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং সংবাদ সম্মেলনে দেয়া খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সমালোচনাই প্রাধান্য পায়।
বৈঠক সূত্র জানায়, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংগঠনিক বিষয় উত্থাপন করেন। তিনি এ সময় কুমিল্লা সিটি নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে মানুষের মন জয় করতে হবে। ভোটারের মন জয় করেই নির্বাচনে জিততে হবে। তবে দলের শৃঙ্খলা ও সিদ্ধান্ত কেউ অমান্য করে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তাদের কঠিন ও কঠোরতম শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন। ছাড় পাবেন না। সূত্র জানায়, আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে হারার কারণে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্ব নিরসনে শীঘ্রই তাদের ঢাকায় তলব করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ভারতে গিয়ে নাকি আমি খালি হাতে ফিরেছি, জনগণকে নাকি অন্ধকারে রেখে ভারতের সঙ্গে সব চুক্তি করেছি! এ কথা খালেদা জিয়া কীভাবে বলেন? আমরা ভারত থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ইউএস ডলার লাইন অব ক্রেডিট এনেছি মাত্র এক শতাংশ সুদে, আমরা ধার এনেছি টাকা। সেটা দিয়ে আমরা প্রয়োজনীয় বিদ্যুত, এলএনজি, এলপিজি, ডিজেল ক্রয় করব। এখন এটাকেও যদি বলা হয় যে কিছুই পায় নাই, তাহলে ভাবখানা এমন যে, আমরা ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিলাম, কিছুই পাইনি। আমরা ভারতে ভিক্ষা আনতে যাই নাই। চোখ থাকতে যদি কেউ অন্ধ হয় তাহলে আমার কিছু বলার নেই। যার চোখ থাকতে অন্ধ তার কপালও মন্দ।
খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনি চীনের সঙ্গে যে সামরিক চুক্তি করেছিলেন তা কার সঙ্গে আলোচনা করে করেছিলেন? আপনার (খালেদা জিয়া) মতো আমি চুপকে চুপকে চুরি করে কোন চুক্তি করিনি। তিনি বলেন, তিস্তা নিয়ে উনি অনেক কথা বলছেন। আমার প্রশ্ন খালেদা জিয়াও তো ক্ষমতায় ছিলেন। উনি ক্ষমতায় থাকতে কেন ভারত থেকে পানি আনতে পারেননি? ভারত সফর শেষে তিনি বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন পানির কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আসলে ভারতে তিনি খোশামোদি, তোষামোদিতে এত ব্যস্ত ছিলেন যে পানি চাওয়ার সাহসই পাননি। শুধু এটা নয়, ভারতের কাছে স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি তোলারও সাহস পাননি। খালেদা জিয়ার বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিএনপির উদ্যোগের কোন কাজের ক্রেডিট আওয়ামী লীগ নিয়েছে বা তারা ক্রেডিট পাওয়ার মতো কি করেছে তা জনসম্মুখে খোলাসা করার জন্যও খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই চুক্তি ভারতের সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এটা আমাদের কূটনৈতিক সাফল্য। এরপরই উদ্যোগ নেই সমুদ্র সীমানা নিয়ে। বিএনপি চেয়ারপার্সন কি কখনও ভারতের কাছে সমুদ্র সীমানা নিয়ে কথা বলেছেন? বলেনি। ভারতের পদলেহনে তিনি এমনই ব্যস্ত ছিলেন যে তোলার সাহসই পাননি। আমি এমনটাই মনে করব। সমুদ্র সীমানার সমাধান আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। আমি ক্ষমতায় আসার পর এ নিয়ে যত তথ্য যোগাড় করার করেছি তা সংশ্লিষ্টদের দিয়েছি। ওই সময় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ডাঃ দীপু মনি। অনেকে ওই সময় তার বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। উনি কেন এত ঘন ঘন বিদেশ সফর করেন ওই সময় বলতে পারিনি। সমুদ্র সীমানা সমস্যা সমাধানে তাকে অনেক দৌড়াতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা-গঙ্গা দূরের কথা আমাদের স্থলসীমা যে চুক্তি করে গিয়েছিলেন জাতির পিতা, সেই স্থলসীমার সমস্যা সমাধানে কোন উদ্যোগ নেয়নি। খালেদার কাছে প্রশ্ন- তার স্বামী জিয়াউর রহমান-এরশাদ ক্ষমতায় ছিল তারা কেন স্থলসীমা নিয়ে কথা বলেননি? আসলে তোলার সাহসই পায়নি। সেটাও আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে। খালেদা জিয়া এই ব্যর্থতার কি জবাব দেশবাসীর কাছে দেবে? সমুদ্র সীমা নিয়েও একই অবস্থা। পদলেহনে এতই ব্যস্ত ছিল যে ন্যায্য হিস্যা নিয়ে কথা বলতে পারেননি।