ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অবসান হুজি যুগের

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

অবসান হুজি যুগের

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্যদিয়ে দেশে মুফতি হান্নানের জঙ্গীবাদী হুজি যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। যদিও হুজি নামে এখনও তৎপরতা রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বক্ষণিক নজরদারি ও অভিযানে আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। মুফতি হান্নানসহ হুজির শীর্ষ জঙ্গীরা গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এসেছে এদেশে জঙ্গীবাদের নানা উত্থান পতনের কাহিনী। রহস্যময় জঙ্গী মুফতি হান্নান, তার দল, অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনসহ জঙ্গীবাদের বহু বিষয় বেরিয়ে এসেছে অজানা সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মুফতি হান্নানের পুরো নাম মুফতি মাওলানা আব্দুল হান্নান মুন্সী। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার হিরণ গ্রামে। মুফতি হান্নান ডানপিটে ছিল ছোটকাল থেকেই। মুফতি হান্নানকে পরিবার ভর্তি করে দেয় গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায়। এরপর পাঠানো হয় বরিশালের শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে পড়াশুনা শেষে তাকে দাওরা হাদিস পড়তে পাঠানো হয় ভারতে। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশুনা শুরু করেন। সেখানে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮৭ সালে ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করে। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের করাচীর জামিয়া ইউসুফ বিন নূরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহশাস্ত্রে পড়াশুনা করতে ভর্তি হয়। এখানেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। পাকিস্তান সংলগ্ন আফগানিস্তানে তখন সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে তালেবানদের শেষ মুহূর্তের প্রচ- যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তান থেকে হান্নান চলে যায় আফগানিস্তানের খোস্ত এলাকায়। সেখানকার একটি মুজাহিদ ক্যাম্পে অস্ত্রগোলাবারুদের প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণ শেষে আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে আহত হয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কুয়েত আল-হেলাল হাসপাতালে ১০ মাস মুফতি হান্নান চিকিৎসা শেষে ফিরে যায় করাচীর মাদ্রাসায়। সেখানে নিয়মিত লেখাপড়া করতে থাকে। তবে পড়াশুনা শেষ হলে। ১৯৮৮ সালে আফগান যুদ্ধ শেষ হয়। দেশে না ফিরে আবার আফগানিস্তানে চলে যান। সেখানকার বিভিন্ন মুজাহিদ ক্যাম্পে ও জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে অস্ত্রগোলাবারুদ তৈরি, পরিচালনা, মজুদ, মেরামতসহ নানা বিষয়ে কলাকৌশল রপ্ত করেন। দেশে ফেরা ও জঙ্গীবাদের বিস্তার ১৯৯৩ সালে দেশে ফেরে। যোগাযোগ করতে থাকেন আফগান ফেরত মুজাহিদদের সঙ্গে। কারণ আফগান যুদ্ধের সময় বহু বাংলাদেশী যুদ্ধে আফগানিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। বাংলাদেশী হিসেবে তাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছিল। যোগাযোগের এক পর্যায়ে আফগানিকে ফেরত কিছু মুজাহিদ নিয়ে ‘জাগো মুজাহিদ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলায় বহুদিন সংগঠনটির অফিস ছিল। হান্নান নিয়মিত অফিস করত। সেখানে আফগান মুজাহিদরা একত্রিত হতো। নানা পরামর্শ হতো। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ফাঁসি হওয়া শীর্ষ জঙ্গী নেতা আফগান ফেরত যোদ্ধা শায়খ আব্দুর রহমান, এসকে আব্দুস সালাম, আহলে হাদিস আন্দোলনের প্রবক্তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসাদুল্লাহ গালিবের সঙ্গে আলাপের মধ্যদিয়ে। ততদিনে আফগান ফেরত যোদ্ধা এসকে আব্দুস সালাম ও আব্দুর রহমান ফারুকীসহ অন্যদের মাধ্যমে হুজিবি নামের একটি সংগঠনের জন্ম হয়। ১৯৯৩ সালে আফগান ফেরত যোদ্ধা মুফতি এসকে আব্দুস সালাম হুজিবির আমির নিযুক্ত হন। আর ১৯৯৪ সালে আরেক আফগান ফেরত যোদ্ধা কিশোরগঞ্জের ভৈরবের বাসিন্দা মুফতি শফিকুর রহমান হুজিবির আমির হয়। সে ১৯৯৪ সালে হুজিবিতে যোগ দেয়। যোগ দিয়েই কোটালীপাড়ার থানা শাখার প্রচার সম্পাদক হয়। অত্যন্ত দক্ষতা আর সাংগঠনিক ক্যারিশমার কারণে অল্প দিনেই তিনি হুজিবির অন্যতম শীর্ষ নেতায় পরিণত হন। হুজিবি মূলত পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল মুজাহিদীনের আদলে গঠিত হয়। পাকিস্তানভিত্তিক এই জঙ্গী সংগঠনটির সঙ্গে তার সর্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। হরকাতুল মুজাহিদীনের বাংলাদেশ অংশের হয়ে কাজ করে মুফতি হান্নান। তার সঙ্গে হুজিবির আমির এসকে আব্দুস সালামসহ অন্য আমিরদের আফগানিস্তানের যুদ্ধ ময়দান এবং পাকিস্তান থেকে যোগাযোগ গড়ে ওঠেছিল। ১৯৯৫ সালে শীর্ষ জঙ্গী নেতা শায়খ আব্দুর রহমান হুজিবিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে হুজিবিই হুজি নাম ধারণ করে। ১৯৯৮ সালে হুজি নিষিদ্ধ হয়। হুজির কার্যক্রম আড়াল করতে নাম পাল্টে ইসলামী দাওয়াতে কাফেলা ও সর্বশেষ ইসলামী গণআন্দোলন নাম দেয়া হয়। তবে গোপনে হুজির কর্মকা- চলছিল। তারা সশস্ত্র জিহাদের পথ বেছে নেয়। যেভাবে আলোচনায় আসে হুজি ও এর প্রধান মুফতি হান্নান ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্যদিয়ে হুজি দেশে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করে। এ হামলায় দশ জন নিহত ও দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। এরপর একের পর এক বোমা ও গ্রেনেড হামলা করে আলোচনা আসে হুজি এবং দলটির প্রধান মুফতি হান্নান। সব মিলিয়ে সাত বছরে হুজি ১৩ জঙ্গী হামলা করে ১০১ জনকে হত্যা করে। আহত করে ৬০৯ জনকে। এরমধ্যে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে দুই দিনের ব্যবধানে ৫৬ কেজি ও ৭৬ ওজনের বোমা পুঁতে রেখে সিলেটে দুই বার শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা এবং সর্বশেষ একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হুজি ও এর প্রধান মুফতি হান্নানের জড়িত থাকার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। গ্রেনেড হামলার পর মানব ঢাল তৈরি করে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তোলার সময় শেখ হাসিনাকে হত্যা নিশ্চিত করতে নাইন এমএম পিস্তল দিয়ে গুলি চালানো হয়েছিল। একুশে আগস্টের হামলায় ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। ওই বছরের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালালের (র.) মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় তিনজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ত্রিশজন। ওই বছরের ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের উপর গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ্ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন। এসব হামলায় হুজি জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ পেলে ব্যাপক আলোচনায় উঠে আসে হুজি প্রধান মুফতি হান্নান।
×