ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৌলবাদী আস্ফালনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

মৌলবাদী আস্ফালনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসবে মৌলবাদীদের বাধা দানের চেষ্টা এবং নানা হুঙ্কারের জবাব দিতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সংস্কৃতিকর্মীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে বৈশাখের দেয়ালচিত্রে কালি লেপন, ভাস্কর্য অপসারণের আবদার এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে অনবরত কথা বলা সরকারের আশকারার কারণেই সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। মৌলবাদীরা মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ আবহমান বাংলা সাম্য শান্তি ও বহুমাত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। এদের সঙ্গে আপোস, দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা দেশের বিরাট ক্ষতি করবে জানিয়ে তারা এই অবস্থার দ্রুত অবসান কামনা করেন। আর মাত্র কদিন পর বাঙালীত্বের বোধ নিয়ে জেগে ওঠার উৎসব পহেলা বৈশাখ। এখন সারাদেশজুড়ে চলছে বাংলা নববর্ষ বরণের প্রস্তুতি। এমন সময় মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ঢুকে বৈশাখের চিত্রকর্ম নষ্ট করেছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। অনুষদের সামনের দেয়ালে আঁকা পটচিত্রে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জীবন সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছিল। সেই পটচিত্র পোড়া মবিল ছিটিয়ে বিনষ্ট করে দেয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। গভীর রাতে ৩টি মোটরসাইকেলে করে আসে ৬ থেকে ৭ দুর্বৃত্ত। ছবি নষ্ট করার পাশাপাশি তারা উপস্থিত শিক্ষার্থী ও শিল্পীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পালিয়ে যায়। তারও আগে থেকে বর্ষবরণ উৎসবের প্রধানতম অনুসঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের আবদার করে আসছিল মৌলবাদী গোষ্ঠী। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভের প্রেক্ষিতে সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় বরিশালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের হুমকি দিয়ে উড়ো দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে অন্ধগোষ্ঠী। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ চরম ক্ষুব্ধ। বাঙালীত্বের বোধ নিয়ে সবাইকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। চট্টগ্রামে বৈশাখের চিত্রকর্ম নষ্ট করা ও মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের মৌলবাদী আবদারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, উদ্ভট দাবি নিয়ে যারা সামনে আসছে আমরা তাদের চিনি। বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির সৌন্দর্য বোঝার ক্ষমতা এদের নেই। এ কারণে বৈশাখের বিরুদ্ধে ওঠে পড়ে লেগেছে। ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী সরকারের প্রশ্রয় পাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, মৌলবাদীদের দাবির মুখে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এ ধরনের পরিবর্তন মৌলবাদীদের উস্কে দিচ্ছে। এ কারণেই চট্টগ্রামের ঘটনা ঘটেছে। ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে অপসারণ করা শুরু হলে সেটি আরেক পরাজয়ের ইতিহাস হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সরকারকে সতর্ক দিয়ে তিনি বলেন, দুই নৌকায় পা দিলে বিপদ অনিবার্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালীরা এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ভবিষ্যতে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করবে বলে জানান তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ এই ধরনের ঘটনার দায় সরাসরি সরকারের বলে মন্তব্য করেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সরকারের নতজানু নীতির জন্যই মৌলবাদীরা লাই পাচ্ছে। এই মৌলবাদীরা কোন না কোনভাবে জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত। জঙ্গীবাদে মদদ দেয়। এরা জঙ্গীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এরা ছায়ানটে হামলা করেছে। পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ধর্মান্ধদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ আবহমান বাংলা অসাম্প্রদায়িকতা মানুষের সমতা সাম্য শান্তির কোনটিই এরা পছন্দ করে না। গ্রহণ করতে শেখেনি। বহুমাত্রিক সংস্কৃতিতে ভয় পায়। বিশ্বাস করে না। তাই আমাদের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক জাগরণের উৎসব পহেলা বৈশাখের বিরোধিতা করেছে। তিনি বলেন, ভাস্কর্য মূর্তি নয়। সুপ্রীমকোর্টে স্থাপন করা ভাস্কর্যের নানন্দিক সৌন্দর্য নিয়ে কথা হতে পারে। তার মানে এই নয় যে, মৌলবাদীদের দাবি মেনে এটি সরিয়ে দিতে হবে। এভাবে চললে তো মুক্তিযুদ্ধের সব ভাস্কর্য তুলে দিতে হবে। একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার দাবি তুলবে জঙ্গীগোষ্ঠী। তখন কী করবে সরকার? প্রশ্ন রাখেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন দুঃখ করে বলেন, এখন বাঙালীর শিল্প সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ হবেÑ এটাই তো স্বাভাবিক। মৌলবাদীরা যেভাবে পত্রিকায় বিবৃতি দিচ্ছে, যেভাবে সরকার তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, ঘরে ডেকে নিয়ে আপ্যায়ন করছে, তাতে ভাল কিছু আশা করা যায় না। আমরা তো ভেবেছিলাম মৌলবাদীরা সরাসরি দল বল নিয়ে মাঠে নামবে। কিন্তু তারা বোধহয় এখনও নিজেদের দুর্বল মনে করছে। তাই এত স্পর্ধা দেখাতে যায়নি। রাতের অন্ধকারে চোরের মতো এসে বৈশাখের দেয়ালচিত্র নষ্ট করেছে। ভাস্কর্য অপসারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাস্কর্য কোথায় থাকবে বা থাকবে না সেটি মুক্তিযোদ্ধারা ডিসাইড করবে। রাজাকাররা নয়। মৌলবাদীরা নয়। কিন্তু আমরা তো দেখলাম মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করার মতো করে বলা হলো। কিন্তু এরা তো খুব চেনা। এদের সঙ্গে কম্প্রমাইস করে ভাল কিছু হবে না। এদের সঙ্গে ফাইট করেই তো আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। ১৯৭১ সালে যেমন সব ধর্ম বর্ণের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল, পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও তা-ই হয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এমন সময় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের আপ্যায়ন কেন? তিনি বলেন, এখন তো মৌলবাদীদের চেয়ে সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া জরুরী। যারা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে বিবৃতি দিচ্ছে তাদের সঙ্গে বসছে সরকার। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকরা এক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়ে পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের ঐক্য জরুরী জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন। পথে নামুন। হাতে হাতে ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করব আমরা। নিজেদের আদর্শ ও চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাব।
×