ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কওমীতে মাস্টার্স ডিগ্রী দিলে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

কওমীতে মাস্টার্স ডিগ্রী দিলে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ সম্পূর্ণ সরকারী নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলা কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রীর স্বীকৃতি দেয়া হলেও তাকে অবশ্যই সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে, শিক্ষাক্রম ও মান নিশ্চিত করে দেয়ার সুপারিশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। দেশের অনেকে ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ এমনকি ইসলামী চিন্তাবিদরাও বলছেন, হেফাজত বা অন্য কারও চাওয়া অনুসারে কোন রকম মান নিশ্চিত না করে কওমীকে সাধারণ শিক্ষার সনদের সমান মর্যাদা দিলে তা দেশের জন্য হবে চরম অন্তর্ঘাতমূলক পদক্ষেপ। সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, যে শিক্ষার কোন হিসাব-নিকাশ নেই, কোর তথ্য নেই, কারা পড়ে. কে পড়ায় কিংবা কী পড়ানো হয় এমন একটি মাধ্যমকে সরকারী স্বীকৃতি দিলেও তা যেন অন্যান্য মাদ্রাসার মতো নিবন্ধনের আওতায় এনে মান নিশ্চিত করে দেয়া হয়। এর আগে মঙ্গলবার রাতে গণভবনে দেশের ‘কওমী মাদ্রাসার আলেমদের সঙ্গে সাক্ষাতকার’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরা-ই হাদিসকে সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ওই অনুষ্ঠানে কওমী মাদ্রাসার একটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও হেফাজতের আমির আহমদ শফী, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ও শোলাকিয়া মসজিদের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদসহ কয়েক শ’ আলেম উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কওমী মাদ্রাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মূল নীতিসমূহের ওপর ভিত্তি করে কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্য) সমমান প্রদান করা হলো। শেখ হাসিনা বলেন, এই সম্মানটা পেলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত আলোর পথে যাত্রা শুরু করবে, অন্ধকারে থাকবে না। তারা দেশে বিদেশে চাকরি করতে পারবে। তারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ পাবে। তাদের জীবনে অনেক সুযোগ আসবে। যেহেতু এই শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতি ছিল না। তারা কোথাও তেমন কোন সুযোগ পেত না। আমি সব সময় মনে করেছি, আমাদের কওমী মাদ্রাসার সরকারী স্বীকৃতি পাওয়া একান্তভাবে দরকার। কী ভাবে পাঠ্যক্রম করা যায় তা নিয়ে এর আগে আহমদ শফীকে প্রধান করে কমিটি গঠনের কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, যে যে পয়েন্টে সবাই এক হতে পারেন, সে সর্বনিম্ন পয়েন্ট নিয়েও আপনারা একটা ব্যবস্থা করে দেন, যাতে কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতিটা দিতে পারি। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, আজকে ওলামায়ে কেরামরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হলো। এটা দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে। কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা আসায় আহমদ শফী শুকরিয়া আদায় করেন এবং আল্লাহর কাছে দেশ ও মানুষের সমৃদ্ধি কামনা করেন। কওমীর এক স্বীকৃতি দিয়ে বছরের পর বছর ধরে দেশের রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে। হেফাজত নেতারা অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াত মদদপুষ্ট হওয়ায় এতদিন এ মাদ্রাসাকে তারা ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। এমনকি আওয়ামী লীগ স্বীকৃতি দিতে চাইলেও তারা এতদিন বলেছে, সরকার মাদ্রাসাকে ধ্বংস করতে চায়। সনদ দিতে হবে যেভাবে কওমী মাদ্রাসা চলছে সেভাবেই। কোন নিয়ন্ত্রণ নিবন্ধন করা যাবে না। যেভাবে যারাই চালাচ্ছেন সেভাবেই চলতে দিতে হবে। এমন অবস্থায় আহমেদ শফী ও মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের অনেকটা সমঝোতার মধ্য দিয়ে সরকার স্বীকৃতির ঘোষণা দিল। তবে এরই মধ্যেই হেফাজতের অনেক নেতা তাদের শিক্ষায় কোন পরিবর্তন ও সরকারী নীতির বাইরেই সনদের দাবি তুলেছেন। তারা দাবি করেছেন, শিক্ষা কারিকুলাম, মান, নিবন্ধন বা কোন কিছুতে হস্তক্ষেপ ছাড়াই সরকারী স্বীকৃতি দেবে সরকার। এটাই দিতে হবে। এ অবস্থায় সনদের এই ধরনের স্বীকৃতিতে শিক্ষাবিদরা অনেকেই বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, শেষ পর্যন্ত সে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। কিন্তু কোন শর্তে সেটি হয়েছে তা পরিষ্কার জরুরী। কারণ, কওমী মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষা তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে সরকারের কোন ভূমিকা নেই। ফলে কে পড়ায়? কি পড়ানো হয়? কারা পরিচালনা করে? পরিচালনার অর্থের উৎস কি? কিভাবে চলছে কেউ কিছু যানে না। কোন প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা কোন রেজিস্ট্রেশনও নেই। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের একটি সাধারণ ধারার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রীর সমমান হবে কওমী মাদ্রাসার দাওয়ায়ে হাদিস ডিগ্রী। ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষাবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে শিক্ষার কারিকুলামে সরকারের হাত নেই, শিক্ষক সম্বন্ধে সরকার জানে না, নেই অবকাঠামো সেই শিক্ষার মানই বা কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার? সরকারী হিসাবে ২০১৫ সালে কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯০২টি। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। এ হিসাবের বাইরেও কয়েক হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। প্রায় ৮০ ভাগ মাদ্রাসা বেফাকের নিয়ন্ত্রণে। আরও পাঁচটি আঞ্চলিক বোর্ড বাকি মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ কওমী মাদ্রাসার কোর্সসমূহে ফারসি ও উর্দু ভাষার প্রাধান্য রয়েছে। বাংলাদেশে এ ভাষার কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ নেই। কওমী মাদ্রাসায় উর্দু এখনও শিক্ষার মাধ্যম ও বাহন হয়ে আছে। শিক্ষকদের মান ও অবকাঠামোও খুব নাজুক। অথচ এসব মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাসিদ পড়া শিক্ষার্থীদের সনদই হবে স্নাতকোত্তর মানের। দেশের সাধারণ শিক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষা বোর্ডগুলোও সর্বোচ্চ এইচএসসি পর্যায়ের ডিগ্রী দিয়ে থাকে। আর স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যাদের কারিকুলাম, শিক্ষকসহ অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সরকার। কিন্তু সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকা কওমী বোর্ডগুলো এবার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী দিবে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বোর্ড কোনভাবেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রী দিতে পারে না। এই সার্টিফিকেট দেয়ার দায়িত্ব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেকটাই বলেছেন একটা কৌশল বের করে কোন পদ্ধতিতে দেয়া যায় তা দেখা হবে। তবে এটা করার আগে অবশ্যই কওমী মাদ্রাসাকে একটি মানের আওতায় আনতে হবে। সরকারী একটি বিধিবিধান মেনে শিক্ষার মান নিশ্চিত করে করতে হবে। কওমীর সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলছিলেন, সরকার কওমী মাদ্রাসার দাবি যেভাবে পূরণ করতে চলেছেন তার ফলাফল শুভ হবে না। পাঠ্যক্রম সাম্প্রদায়িকীকরণ ও এই স্বীকৃতি হবে দেশের জন্য চরম অন্তর্ঘাতমূলক। সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন একটি শিক্ষাকে যদি মাস্টার্সের মর্যাদা দেয়া হয় তবে দেশের হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান বা কেউ একইভাবে স্বীকৃতির দাবি করলে সরকার দিতে বাধ্য। না হয় তারা বৈষম্যের কথা তুলতেই পারেন। অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন আরও বলছিলেন, মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সহজেই চাকরির বাজারে ঢুকতে পারবে না। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কোনভাবেই কওমীর শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রাধান্য দেবেন না। এখন কেউ যদি একটি সংস্থা করে সনদ দিতে থাকে তাহলে সেটাকেও বৈধতা দিতে হবে। আর সরকার যদি সেটা না দেয় তাহলে দুই সংস্থার সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করা হবে। আসলে কওমীর এই সনদের স্বীকৃতি নিয়ে পরবর্তীতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে। সেই জটিলতা থেকে মুক্ত হতে সরকারকে আরও অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা কোনভাবেই এভাবে কওমী মাদ্রাসার সনদকে সমর্থন করি না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমরা এখনও স্পষ্ট না কোন ধরনের নিয়মে এই কওমী শিক্ষা পরিচালিত হবে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগে কিন্তু একই ডিগ্রীর জন্য কওমী মাদ্রাসা কী ভাবে পরিচালিত হবে? তাদের কারিকুলাম, অর্থের যোগান কিভাবে হবে তা স্পষ্ট করে ব্যবস্থা না নিলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায়ই চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। নারী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, যারা নারী নেতৃত্বকেই অস্বীকার করে তাদের সঙ্গে কিভাবে সমঝোতা হয়? তিনি বলেন, সকল কওমী মাদ্রাসাকে আগে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। কারিকুলাম ঠিক করতে হবে।
×