ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চারুকলা শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রে মবিল ঢেলে দিয়েছে মৌলবাদীরা

চট্টগ্রামে বৈশাখের চিত্রে ছোবল

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

চট্টগ্রামে বৈশাখের চিত্রে ছোবল

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মৌলবাদী চক্র বাঙালীর জাতীয় উৎসবকে টার্গেট করে ফণা তুলেছে। এ উৎসব ধর্মীয় নয়। ধর্মবিরোধীও নয়। এ উৎসব বাঙালী জাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতে সারাদেশ যখন উন্মুখ, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ যাবতীয় সকল প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন ঠিক তখনই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চারুকলা শিক্ষার্থীদের দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল বিস্তীর্ণ দেয়ালজুড়ে অঙ্কিত বাঙালীর আবহমান সাংস্কৃতিক চিত্রের ওপর ছোবল মেরেছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা বিস্তীর্ণ দেয়ালজুড়ে অঙ্কিত শৈল্পিক কারুকাজের ওপর মবিল ছিটিয়ে একাকার করে দিয়েছে। বিনষ্ট হয়ে গেছে বাঙালী সংস্কৃতির রূপ রস গন্ধে ভরা সেই শৈল্পিক চিত্র। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সকল সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, এ কাজ মৌলবাদী চক্রের। এরা বাঙালীর আচার সামাজিক রীতিনীতিকে রদ করতে চায়। ঘটনার পর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শহর এলাকার বাদশা মিয়া রোডে অবস্থিত চারুকলা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাস সড়ক সংলগ্ন জেমস ফিনলে (বিডি) এর মালিকানার পাহাড়ের পাদদেশের বিস্তৃত দেয়ালজুড়ে অঙ্কিত নান্দনিক সৌন্দর্যের সাংস্কৃতিক এই চিত্রকলার ওপর মবিল ছিটিয়ে দেয়ার ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠন ও বাঙালী সংস্কৃতিমনাদের মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর পুলিশ বলেছে, এ অপকর্ম যারা করেছে তাদের খুঁজে বের করার তদন্ত শুরু হয়েছে। সিসি ক্যামেরায় ধারণ হয়ে থাকলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে তারা আশা করছেন। বর্ষবরণকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্র মবিল ঢেলে নষ্ট করে দেয়ার ঘটনাটি মৌলবাদী চক্রের ঔদ্ধত্য বিষাক্ত ফণা মাথাছাড়া দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। মৌলবাদী দুর্বৃত্তরা মঙ্গলবার মধ্যরাতে শহর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রবেশমুখের দেয়ালে এ অপকর্ম ঘটানোর সুযোগ নিয়েছে এলাকাটি সন্ধ্যার পর জন ও যানবাহন চলাচল কম থাকে বিধায়। উল্লেখ্য, বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে প্রতি বছরই চৈত্রের শেষ সময়টাতে ব্যস্ত সময় কাটান চবি চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এ সময়টায় বিভিন্ন দেয়ালচিত্র এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য বিভিন্ন ধরনের মুখোশ, পুতুল, মাছসহ শিল্পকর্ম তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তারই ধারাবাহিকতায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রবেশমুখের দেয়ালে অঙ্কন করা হয় বাঙালীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সামষ্টিক ঐতিহ্যের চিত্র নিয়ে। চারুকলা ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জনকণ্ঠকে জানানো হয়, মঙ্গলবার প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত তারা এ দেয়ালে চিত্র অঙ্কন সম্পন্ন করেন। পরে শিক্ষার্থীরা যার যার কক্ষে চলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আনুমানিক রাত ১টার দিকে তিনটি মোটরসাইকেল চড়ে ৬-৭ জন এসে অঙ্কিত চিত্রে মবিল ছিটিয়ে নষ্ট করে দেয়। এ সময় তারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গালাগাল করে বলেও জানিয়েছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী চারুকলার শিক্ষার্থী এস এম আল মাহমুদ। চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এটিকে ঘৃণিত ও বাঙালী সংস্কৃতিবিরোধী মনোভাবাদের কাজ উল্লেখ করে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের স্লোগান হচ্ছে ‘জঙ্গী নির্মূল চেতনায় শাণিত বৈশাখ।’ মনে হচ্ছে এই স্লোগানে ভীত হয়ে একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিভাবে এ কা- ঘটিয়েছে। তাদের এ অপতৎপরতা আমাদের দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের কোন ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের অনুষ্ঠান নির্বিঘœ করতেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক জাহেদ আলী চৌধুরী যুবরাজ সাংবাদিকদের জানান, বাঙালি সংস্কৃতিতে যারা প্রতিপক্ষ মনে করে থাকেন তারাই যে এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা স্পষ্ট। যারা এ ঘৃণ্য কাজ করেছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি বিধানের দাবি জানান তিনি। চারুকলার শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জানান, রাতের অন্ধকারে যারা এমন কাজ করে তারা কাপুরুষ। এভাবে আমাদের দমানো যাবে না। আমরা আরও দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করব। এ এলাকার দেয়ালগুলো ভরিয়ে তুলব। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলের আশপাশে কিছু সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেগুলো থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করে দেয়াল চিত্র বিনষ্টকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া বর্ষবরণকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বিভিন্ন সংগঠন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
×