ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুফতি হান্নান শাহেদুল ও রিপন ॥ তিন জঙ্গীর ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

মুফতি হান্নান শাহেদুল ও রিপন ॥ তিন জঙ্গীর ফাঁসি

মশিউর রহমান খান/আরাফাত মুন্না/সালাম মশরুর/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু ॥ সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার এক যুগেরও বেশি সময় পর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হলো হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি মাওলানা আবদুল হান্নান মুন্সি ওরফে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গীকে। বুধবার রাত ১০টায় কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের একই মঞ্চে একই সময়ে মুফতি হান্নানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুলের এবং রাত ১০টা ১ মিনিটে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে মুফতি হান্নানের অপর সহযোগী হুজি সদস্য রিপনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন এই তিন জঙ্গীর মৃত্যুদ- কার্যকরের বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেন। এর মাধ্যমে হুজি নেতা মুফতি হান্নান যুগের অবসান ঘটল। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকরের ১০ বছর পর ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হলো এই তিন জঙ্গীকে। পাকিস্তানী ও আফগান জঙ্গীদের কায়দায় খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন এই মুফতি হান্নানই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গোপালগঞ্জের কোটালি পাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা মাটির নিচে পুঁতে রেখে হত্যার চেষ্টা করে। এছাড়াও আরও কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করে এই জঙ্গী নেতা। কুখ্যাত এই জঙ্গী ১৭টি চাঞ্চল্যকর মামলায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কারাভোগ করে আসছিলেন। ফাঁসি কার্যকরের পর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান কারাফটকে সাংবাদিকদের জানান, রাত ১০টায় মুফতি আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ওরফে বিপুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সিনিয়র জেল সুপার ছগির মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি বুধবার রাত ১০টা ১ মিনিটে কার্যকর করা হয়েছে। পরে তিন জঙ্গীর লাশই ময়নাতদন্তের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া পাহারায় তাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। মুফতি হান্নানের লাশ গোপালগঞ্জে, শরীফ শাহেদুল বিপুলের লাশ চাঁদপুরে এবং রিপনের গ্রামের বাড়ি সিলেটের কুলাউড়ায় পাঠানো হয়। ফাঁসি কার্যকরের আগে বুধবার সকালে মুফতি হান্নানের সঙ্গে শেষ বারের মতো দেখা করেছেন স্বজনরা। সন্ধ্যায় সিলেটে জঙ্গী রিপনের পরিবারের সদস্যরাও শেষ দেখা করে গেছেন। তবে কারা কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠালেও জঙ্গী বিপুলের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি তার পরিবারের সদস্যরা। এমনকি বিপুলের লাশও গ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছে তার পরিবার। এদিকে বুধবার বিকেল থেকেই কাশিমপুর ও সিলেট কারাগারের আশপাশের এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। জঙ্গীদের ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে কারাগার ও আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিকেল থেকে একটু পর পর ফাঁসি সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা কারাগারে প্রবেশ শুরু করেন। এক পর্যায়ে সন্ধ্যার পর দুই কারাগারেই এ্যাম্বুলেন্স প্রবেশের পরই নিশ্চিত হয়ে যায় বুধবারই জঙ্গীদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। একদিন আগে মঙ্গলবার রাত ৯টায় দুই কারাগারে আনা হয় কফিন। এদিকে বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও রাতেই তিন জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। মুফতি হান্নান ও বিপুলের ফাঁসি কাশিমপুর কারাগারে ॥ এই কারাগারের হিমেল ভবনের নিচতলার ৬ নম্বর কক্ষে মুফতি হান্নান ও ৪ নম্বর কক্ষে বিপুলকে রাখা হয়েছিল। বুধবার সন্ধ্যার আগেই ডিআইজি (প্রিজন্স) তৌহিদুল ইসলাম ও রাত ৮টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন ফাঁসির মঞ্চ ও সার্বিক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এরপর ফাঁসি সংশ্লিষ্ট কারাগার ও কারাগারের বাইরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক করেন। কারা সূত্র জানিয়েছে, মুফতি হান্নান ও বিপুল দু’জনেই সবজি দিয়ে ভাত খেয়েছে। তাদের দু’জনকেই তওবা পড়ান কারা মসজিদের সহকারী ইমাম হাফেজ মওলানা আবু নোমান। পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ইশারা পাওয়ামাত্রই জল্লাদ রাজু, সাকু বেপারী ও ইকবাল মুফতি হান্নান ও বিপুলের মৃত্যুদ- কার্যকর করে। এ সময় ডিআইজি প্রিজন্স (ঢাকা বিভাগ) তৌহিদুল ইসলাম, গাজীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিসি এস এম আলম, জেলা পুলিশ সুপার মোঃ হারুন অর রশিদ, সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান, ডেপুটি জেলার মনিরুল ইসলাম, সিভিল সার্জন সৈয়দ মঞ্জুরুল হক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাহেনুল ইসলাম ও কারা মসজিদের সহকারী ইমাম হাফেজ মাওলানা আবু নোমান মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন। পরে ময়নাতদন্ত শেষে রাত ১২টা ৪ মিনিটে এই দুই জঙ্গীর লাশ এ্যাম্বুলেন্সযোগে কারাগার থেকে বের করে অইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। রিপনের ফাঁসি সিলেটে ॥ সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বুধবার রাত ১০টা ১ মিনিটে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় মুফতি হান্নানের অপর সহযোগী হুজি সদস্য দেলোয়ার হোসেন রিপনের। এর আগে তাকে তওবা পড়ান সিলেট নগরীর শাহ আবু তোরাব জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মুফতি বেলাল উদ্দিন। তাকে নিয়ে বুধবার রাত পৌনে ৯টার দিকে সিলেট কারাগারে প্রবেশ করেন ডিআইজি প্রিজন্স একেএম ফজলুল হক। তওবা পড়ানো শেষে রাত ১০টা ১ মিনিটে ম্যাজিস্ট্রেটের ইশারায় রিপনের মৃত্যুদ- কার্যকর করে ৮৫ বছর সাজাপ্রাপ্ত আসামি জল্লাদ ফারুকের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি দল। ময়নাতদন্ত শেষে রাত ১১টার দিকে রিপনের লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স কারাগার থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়ে ১২টা ১৫ মিনিটে কুলাউড়ায় তার বাড়িতে পৌঁছায় বলে জানা গেছে। আগে গত ১৯ মার্চ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে মুফতি হান্নানের রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে গত ২২ মার্চ তাকে কারাগারে মৃত্যুদ- বহাল রাখার রায় পড়ে শোনানো হয়। ২৩ মার্চ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যু পরোয়ানা পাঠানো হয়। এরপর কারাবিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করে আসামিরা। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ কুখ্যাত এই তিন জঙ্গীর প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করার পর থেকেই ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। কারাবিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ আসামিদের শোনানোর পর ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয় এমন সময়ের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে এই তিন জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকরের সময় শুরু হয়। এর পর ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত মহরাও সেরে নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। মুফতি হান্নানের সঙ্গে পরিবারের শেষ সাক্ষাত ॥ কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান জানান, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী বিপুলের পরিবারের সদস্যদেরও শেষ বারের মতো সাক্ষাতের জন্য সোমবার রাতেই তার বাড়িতে চিঠি পাঠানো হয়। কারা কর্তৃপক্ষের ডাকে মুফতি হান্নানের সঙ্গে শেষ বারের মতো সাক্ষাত করতে মুফতি হান্নানের বড় ভাই আলি উজ্জামান মুন্সি, হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভীন রুমা এবং ছোট মেয়ে নাজনীন খানম ও বড় মেয়ে নিশি খানম বুধবার সকালে কারাগারে এসে তার সঙ্গে শেষ বারের মতো দেখা করেন। সকাল ৭টা ১০ থেকে ৭টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত প্রায় ৪০ মিনিট কথা বলেন তারা। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাতেই মুফতি হান্নানের স্ত্রী, দুই মেয়ে ও বড় ভাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হিরণ এলাকার গ্রামের বাড়ি থেকে কাশিমপুর কারাগারের উদ্দেশে রওনা দেন। এদিকে মুফতি আবদুল হান্নানের সঙ্গে তার কারাবন্দী দুই ভাইও দেখা করেছেন। বুধবার বেলা ২টার দিকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে থাকা বন্দী মোঃ মহিবুল ও গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের বন্দী মোঃ আনিসের সঙ্গে মুফতি হান্নানের সাক্ষাত করানো হয়। এ সময় মুফতি হান্নান তার মায়ের সঙ্গে মোবাইলে শেষ বারের মতো কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে। এ সময় তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। বুধবার সকালে মুফতি হান্নানের সঙ্গে কারাগারে পরিবারের চার সদস্যের সাক্ষাত শেষে তার বড় ভাই আলি উজ্জামান কারা এবং স্ত্রী জাকিয়া পারভীন রুমা কারা ফটকের সামনে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান। হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভীন রুমা জানান, মুফতি হান্নান ভাল আছেন, সুস্থ আছেন। কারাভ্যন্তরে সাক্ষাতকালে হান্নান বলেছেন, যে মামলায় তাকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে এটা মিথ্যা মামলা। তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। এ সময় তিনি তার পরিবারের সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেন। সিলেটে রিপনের সঙ্গেও দেখা করেছে পরিবারের সদস্যরা ॥ সিলেট কারাগারে থাকা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্য দেলোয়ার হোসেন রিপনের সঙ্গে তার পরিবারের চার সদস্য শেষ বারের মতো সাক্ষাত করেছেন। বুধবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে রিপনের বাবা আঃ ইউসুফ, মা আজিজুন্নেছা, ভাই নাজমুল ইসলাম ও তার স্ত্রী এবং কয়েকজন শিশুসহ পরিবারের ১৫ সদস্যের একটি দল রিপনের সঙ্গে দেখা করেন। তারা প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সময় কথা বলেন। বিপুলের লাশ গ্রহণে পরিবারের অস্বীকার ॥ কারা কর্তৃপক্ষ শেষ বারের মতো সাক্ষাত করতে ডেকে পাঠালেও মুফতি হান্নানের সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুলের সঙ্গে তার পরিবারের কেউ সাক্ষাত করতে আসেনি। বরং তার পরিবারের পক্ষ থেকে মৃত্যুদ- কার্যকরের পর তার লাশ গ্রহণ করতেও অস্বীকৃতি জানানো হয়। তিন জঙ্গীর প্রাণভিক্ষার আবেদন ॥ মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া তিন জঙ্গীই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনে করেছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ তিনটি আবেদনই খারিজ করে দেন। কারা সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির কাছে করা প্রাণভিক্ষার আবেদনে মুফতি হান্নান ও শরীফ বিপুল বর্তমান সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দেশ স্বাধীনের জন্য অবদান ও জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা স্বীকার করে অনেক প্রশংসামূলক বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও সফলতার কথাও বলেছেন। সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে তার প্রাণভিক্ষা দেয়ার জন্য আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে। কারা সূত্র আরও জানায়, অপর আসামি দেলোয়ার হোসেন রিপন সিলেট কারাগারে থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। জানা গেছে, আবেদনে তিনি বলেছেন কোন প্রকার জঙ্গী বা খারাপ কাজের সঙ্গে সে জড়িত নয়। সে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে, প্রাণ ভিক্ষা চায়। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ॥ কাশিমপুর ও সিলেট কারাগারে তিন জঙ্গীর ফাঁসিকে কেন্দ্র করে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলগেট ও আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার কারাগার এলাকা পরিদর্শন করেন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপাররা। এ সময় তারা বলেন, মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী বিপুল ও রিপনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা নিয়ে আমরা প্রস্তুত। পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও কারা গোয়েন্দাসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কারাগার এলাকায় কাজ করছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ফিরে দেখা ॥ সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় ২০০৪ সালের ২১ মে কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ৭ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, তার ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার ওরফে রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। যথাযথ ঠিকানা না থাকায় মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ ওরফে খাজার নাম প্রথমে বাদ দেয়া হলেও পরে তাকে যুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই বছর নবেম্বরে হয় অভিযোগ গঠন। ৫৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সামীম মোঃ আফজাল রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের মধ্যে মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন) শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রায় দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ। তাতে আসামিদের আপীল খারিজ হয়ে যায়, মুফতি হান্নানসহ তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং দুইজনের যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল থাকে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করেন হান্নান ও বিপুল। আর দেলোয়ারের পক্ষে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়েও ওই তিন আসামির সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। আপীল বিভাগের রায় হাইকোর্ট হয়ে নিম্ন আদালতে যাওয়ার পর বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং তা গত ৩ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পৌঁছায়। সেখানেই আসামিদের মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন। তাদের আবেদন গত ১৯ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে যায়। প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় সাংবিধানিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন তিন জঙ্গী। তাদের সেই আবেদন নাকচ হয়ে গেছে বলে ৯ এপ্রিল সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মুফতি হান্নানের পরিবারের সদস্যরা বুধবার সকালে এবং রিপনের স্বজনরা সন্ধ্যায় কারাগারে গিয়ে ওই দুই জঙ্গীর সঙ্গে শেষ দেখা করেন। বিপুলের পরিবারের সদস্যদের খবর দেয়া হলেও তারা কারাগারে যাননি। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে কারাবিধি মেনে বুধবার রাতে কাশিমপুরে হান্নান ও বিপুল এবং সিলেট কারাগারে রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। যেভাবে আলোচনায় আসে হুজি ॥ ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে হুজি দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা (খেলাফত) কায়েম করতে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করে। এ হামলায় দশজন নিহত ও দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। এরপর একের পর এক বোমা ও গ্রেনেড হামলা করে আলোচনা আসে হুজি এবং দলটির প্রধান মুফতি হান্নান। সবমিলিয়ে সাত বছরে হুজি ১৩টি জঙ্গী হামলা করে ১০১ জনকে হত্যা করে। আহত করে ৬০৯ জনকে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে দুই দিনের ব্যবধানে ৫৬ কেজি ও ৭৬ ওজনের বোমা পুঁতে রেখে, সিলেটে দুইবার শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা এবং সর্বশেষ একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হুজিপ্রধান মুফতি হান্নানের জড়িত থাকার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। গ্রেনেড হামলার পর মানবঢাল তৈরি করে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তোলার সময় শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতে নাইন এমএম পিস্তল দিয়ে গুলি চালানো হয়েছিল। একুশে আগস্টের হামলায় ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। ওই বছরের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালালের (র.) মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় তিনজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন। ওই বছরের ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন। এসব হামলায় হুজি জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ পেলে ব্যাপক আলোচনায় উঠে আসে হুজিপ্রধান মুফতি হান্নান। হান্নানের বিরুদ্ধে আরও ১৬ মামলা বিচারাধীন ॥ ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে হামলার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মুফতি হান্নানকে। তবে রমনা বটমূলে হামলা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হলেও আনোয়ার চৌধুরীর মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর করা হলো। এ দুটি মামলা ছাড়াও ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ আরও ১৫টি জঙ্গী হামলার মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মুফতি হান্নানের আরেক সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। তবে এই দুই আসামির মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ওই সব মামলা থেকে তারা স্বাভাবিকভাবেই অব্যাহতি পাবেন।
×