ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর কুমার দে

হরকত-উল-জিহাদের যত হামলা

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

হরকত-উল-জিহাদের যত হামলা

হরকত-উল-জিহাদ (হুজি) প্রধান মুফতি হান্নান কেবল শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই পাঁচবার হামলা ও হামলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছেন তিনি। এছাড়া তার পরিকল্পনা ও নির্দেশে সাত বছরে ১৩টি জঙ্গী হামলা হয়। তাতে নিহত হয় ১০১ জন। আহত হন ৬০৯ জন। এছাড়া জঙ্গীরা বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের ২০০৫ সাল পর্যন্ত শ’খানেক বোমা হামলার ঘটনা ঘটায়। আহতদের মধ্যে অনেককেই চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে। মুফতি হান্নানসহ শীর্ষ জঙ্গীরা গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন মুফতি হান্নান। এরপর বিভিন্ন মামলায় টানা ১২০ দিন রিমান্ডে ছিলেন। সর্বশেষ ২০০৬ সালের ১৯ নবেম্বর এবং ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর দুই দফায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে এসব হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ পায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হুজির চালানো ১৩টি জঙ্গী হামলায় ১০১ জন নিহত হন। আহত হন ৬০৯ জন। এসব হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন হুজিবি ও হরকত-উল-মুজাহিদীনের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে হুজি দেশে জঙ্গী হামলা শুরু করে। ওই হামলায় দশ জন নিহত হন। আহত হন দেশ শতাধিক। হুজিবির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সিদ্ধান্তে মুফতি হান্নান ও মুফতি আবদুর রউফের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ওই হামলা চালায় হুজি সদস্যরা। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় আটজন নিহত হন। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে ৫৬ কেজি ওজনের বোমা পূঁতে রাখা হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে উড়িয়ে দিতেই বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু গোয়েন্দা তৎপরতায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তার দুইদিন পর ২৩ জুলাই শেখ হাসিনার কোটালীপাড়ায়ই আরেকটি সমাবেশস্থলের অদূরে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পূঁতে রাখা রেখেছিল মুফতি হান্নান। শেখ হাসিনাকে হত্যার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হুজি ও জেএমবিকে একত্রে দায়িত্ব নেয়। ২০০০ সালে সিলেটেও একবার শেখ হাসিনার উপর হামলার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। ২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিলেটে শেখ হাসিনার সমাবেশের কাছে বোমা হামলায় ২ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২৫ জন। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওইদিন শেখ হাসিনার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পিস্তল থেকে গুলিও চালানো হয়েছিল। হামলায় ২৪ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। সূত্র বলছে, শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখার পর আলোচনায় আসে মুফতি হান্নান। এরপর থেকে তিনি ও তার দল আত্মগোপনে থেকেই তৎপরতা চালাতে থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা করে হুজি। হামলায় ৫ জন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক। ২০০১ সালের ৩ জুন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বানিয়ারচর ক্যাথলিক মিশনারি চার্চে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন। ২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বোমা নারী শিশুসহ ২১ জন নিহত হন। সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ শতাধিক আহত হন। ২০০১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের মোল্লারহাটে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক। ২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের শাল্লায় প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমাবেশের কাছে বোমা হামলায় চার জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন। ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা শহরের রক্সি সিনেমা হলে এবং গুড়পুকুরের মেলায় ১০ মিনিটের ব্যবধানে একাধিক বোমা হামলা হয়। হামলায় এক স্কুলছাত্রসহ ৩ জন নিহত হয়। আহত হন শতাধিক। এ মামলাটি জেএমবি করছিল বলে পরবর্তীতে জানতে পারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এছাড়া ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সিলেটে হযরত শাহজালাল (রা.) মাজারে উরস চলাকালে বোমা হামলায় ৫ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন। ২০০৪ সালের ২৮ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঐহিত্যবাহী পৌষ মেলার পিঠা উৎসবে বোমা হামলায় ২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অন্তত ২০ জন। ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা হয়। এতে তিন জন নিহত হন। আহত হন সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল হোসেনসহ শতাধিক। ২০০৪ সালের ২১ জুন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় একজন নিহত হন। আহত হন ৭০ জন। মঞ্চে থাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অল্পের জন্য বেঁচে যান। একই বছরের ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের উপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি জঙ্গীরা। হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম আলীর মৃত্যু হয়। আহত হন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজসহ অন্তত ৫০ জন। হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বশেষ গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে। ওই হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন। এসব ঘটনায় মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে মোট ১৭টি মামলা হয়। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলাসহ দুইটি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার দায়ে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গীর ফাঁসি ও দুজনের যাবজ্জীবন কারাদ- দেন বিচারিক আদালত। এ ছাড়া ২০০১ সালে রমনায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলায় হান্নানসহ হুজির আট জঙ্গীর মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ-াদেশ অনুমোদন) হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। হান্নানের বিরুদ্ধে থাকা অন্য মামলাগুলোর মধ্যে ১৩টি বিচার চলছে। এরমধ্যে দুটির অধিকতর তদন্ত হচ্ছে। সর্বশেষ মুফতি হান্নানকে ঢাকা থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে নেয়ার সময় টঙ্গী থেকে তাকে ছিনিয়ে নিতে হামলা হয়েছিল। [আজ সমাজ ভাবনা দেখুন ১৬-এর পাতায়]
×