ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হুজি-সন্ত্রাস ও মুফতি হান্নান

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

হুজি-সন্ত্রাস ও মুফতি হান্নান

নিষিদ্ধ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি মাওলানা আব্দুল হান্নান মুন্সী ওরফে মুফতি হান্নান যুগের অবসান ঘটছে। সেই সঙ্গে সমাপ্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের এক কালো অধ্যায়ের। আফগান ফেরত যোদ্ধা মুফতি মাওলানা এস কে আব্দুুস সালাম বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তনকারীদের অন্যতম। কাকতালীয় হলেও সত্য, এস কে আব্দুস সালামের জন্ম সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়ায়। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। আর এস কে আব্দুস সালামের ঘনিষ্ঠ হুজি প্রধান মুফতি হান্নান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। শেখ হাসিনা আর মুফতি হান্নানের জন্মও একই জেলা গোপালগঞ্জে। মুফতি হান্নানসহ শীর্ষ জঙ্গীরা গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে এদেশের জঙ্গীবাদের অনেক অজানা কাহিনী। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের মূল সূত্রপাত হয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর। যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে পরাজিত হয় জামায়াতে ইসলামী। দেশ স্বাধীন হলে পরাজিত শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে জামায়াতে ইসলামী নানা কৌশলে সংগঠিত হতে থাকে। দলটির প্রত্যক্ষ মদদে দেশে জঙ্গী সংগঠনের জন্ম হতে থাকে। বাংলাদেশে যে ক’জন জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটিয়েছেন, তাদের সবাই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। আফগান যুদ্ধ ও বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের বিস্তার বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তনকারীদের অন্যতম মুফতি মাওলানা এস কে আব্দুস সালাম। পিতার নাম এস কে মাজহার আলী। বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট থানার পানশীবাড়ি গ্রামে। বগুড়ার শেরপুর উপজেলাধীন ফাতেমা-তুজ-জোহরা মহিলা মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ১৯৭৮ সালে দাওরা হাদিস পড়তে পাকিস্তানের লাহোরের জামিয়া আশরাফিয়া মাদ্রাসায় (কওমী মাদ্রাসা) ভর্তি হন। ১৯৭৯ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। চলে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানে থাকার সময় ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের মধ্যেই সম্মেলনের ডাক দেন আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন। আফগানিস্তানের খোস্ত শহরে আল কায়েদার সেই সম্মেলনে বিদেশী যোদ্ধা হিসেবে তিনি ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক কথা বলার সুযোগ পান। লাদেনের কথায় বাড়তি মনোবল পেয়ে আফগান যুদ্ধে অংশ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। আফগানিস্তানের খোস্ত শহরের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে একে-৪৭ রাইফেলসহ ভারি অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। তার মতো হুজি প্রধান মুফতি হান্নানও পাকিস্তানে পড়তে গিয়েছিলেন। দু’জনই আফগানিস্তানের খোস্ত শহরের জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর যোগ দেন আফগান যুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্রে সালামের বাংলাদেশী সাথী শেখ ইসমাইল ও মঞ্জুর হাসান, পাকিস্তানের করাচীর বাসিন্দা শাহাদৎ হোসেন ও আব্দুর রহমান নিহত হন। যুদ্ধ থেকে এস কে সালাম ও বাংলাদেশী আব্দুর রহমান ফারুকী এবং পাকিস্তানী আলমাস জীবিত ফেরেন। পরবর্তীতে আলমাস পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গায় নিহত হন। ১৯৮৭ সালে আবার তিনি আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের লাহোরের মাদ্রাসায় ফিরে যান। ১৯৮৮ সালে এখান থেকে দাওরা হাদিস পাস করেন। ১৯৮৮ সালের নবেম্বরে আবার আফগান যুদ্ধে অংশ নেন। টানা তিন মাস যুদ্ধ করেন। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের করাচিতে সেই মাদ্রাসায় চলে যান। সেখান থেকে ওই বছরের মার্চে দেশে ফেরেন। ফিরেই জঙ্গী তৎপরতা শুরুর চেষ্টা করতে থাকেন। আহলে হাদিস আন্দোলন আফগান যুদ্ধের সময় দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা (খেলাফত) কায়েম করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসাদুল্লাহ গালিবের আহলে হাদিস আন্দোলন করছিলেন। আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীসহ বিদেশী চক্রগুলো আহলে হাদিস আন্দোলনকে পুঁজি করে ১৯৯০ সাল থেকে সহায়তা করতে থাকে। গঠিত হয় তাওহিদ ট্রাস্ট। ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক গালিব আর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রেজাউল করিম। আহলে হাদিস আন্দোলন বিভক্ত এবং প্রকাশ্যে জঙ্গীবাদ মতপার্থক্য ও ফান্ডের টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে অধ্যাপক রেজাউল করিম আলাদা হয়ে যান। অধ্যাপক গালিব চেয়েছিলেন মানুষকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আস্তে আস্তে দেশে খেলাফত কায়েম করার পরিবেশ তৈরি করতে। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে খেলাফত কায়েম করতে আহলে হাদিস থেকে ফান্ডের টাকার ভাগ নিয়ে বেরিয়ে যান শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানিসহ ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া শীর্ষ ছয় জঙ্গী। ধাপে ধাপে জন্ম হয় হুজি, জামা’আতুল মুজাহিদীন ও জেএমজেবির। হুজির (হরকাতুল জিহাদ) জন্ম ১৯৮৯ সালে আফগান যুদ্ধ করে যশোরের বাসিন্দা আব্দুর রহমান ফারুকী দেশে ফেরেন। তিনি হরকাতুল জিহাদিল ইসলামী নামের দল গঠন করেন। পরে সেটি হরকত-উল-জিহাদ অব বাংলাদেশ সংক্ষেপে হুজিবি হয়। পরে হুজিবিই হুজি হয়। আব্দুর রহমান ফারুকী হুজিবির আমির নিযুক্ত হন। আমির থাকা অবস্থায়ই তিনি ১৯৮৯ সালে আবার আফগানিস্তানে চলে যান। ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানের নজীবুল্লাহ সরকারের সঙ্গে আফগান মুজাহিদদের এক ভয়াবহ যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়। এ সময় আফগান ফেরত যোদ্ধা মুফতি আব্দুল হাই দলের আমির হন। পরে তিনি আবারও আফগানিস্তানে যান। আফগান যুদ্ধে ছাত্র শিবিরের ১ হাজার ৮০ সহ কয়েক হাজার বাংলাদেশী অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে প্রায় তিন হাজার দেশে ফেরত আসে। মুফতি হান্নানের সঙ্গে শীর্ষ জঙ্গী ও আন্তর্জাতিক কানেকশন আফগান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মুফতি হান্নান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। আফগানিস্তানের খোস্ত শহরের কাছে জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তিনি গ্রেনেডসহ শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরি ও পরিচালনা, ভারি আগ্নেয়াস্ত্র চালনা, তৈরি ও মজুদসহ সমরাস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত হন। সেখানে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা, লস্কর-ই-তৈয়বা, পাকিস্তানভিত্তিক আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠন জৈইশ-ই-মোস্তফা, জইশ-ই-মোহাম্মদসহ বহু জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। বিদেশী হিসেবে আফগানিস্তানে শীর্ষ ছয় জঙ্গী ছাড়াও ভারতের মোস্টওয়ান্টেড জঙ্গীর সঙ্গে যুদ্ধ ময়দানে পরিচয় হয়। ১৯৯৩ সালে দেশে ফেরেন। যোগ দেন হুজিবিতে। এরপর একের পর হামলার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে থাকে হুজি ও মুফতি হান্নানের কর্মকা-। হুজি থেকে তা আমির উদ্ দ্বীনের জন্ম যেভাবে হুজি বিল্প্তু ঘোষণার পর ১৯৯৪ সালে দলটিতে যোগ দেয়া আফগান ফেরত যোদ্ধা মুফতি মাওলানা আব্দুর রউফ দলটি ছেড়ে চলে যান। পরে তিনি তা আমির উদ্ দ্বীন নামে একটি নতুন জঙ্গী দল গঠন করেন। তিনি দলটির আমির হন। দলটির বর্তমানে যৎসামান্য কার্যক্রম রয়েছে। তা আমির উদ্-দ্বীন থেকে ইসলামী জিহাদ আন্দোলন ১৯৯৪ সালে চাঁদপুরের হাইমচরের বাসিন্দা আফগান ফেরত যোদ্ধা আবু জিহাদ হুজিবিতে যোগ দেন। তিনি মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে জিহাদের দাওয়াত দেয়া ও জঙ্গীদের অস্ত্র-গোলাবারুদের ট্রেনিং দিতেন। চট্রগ্রামের নাইক্ষ্যংছড়ির গহীন জঙ্গলের জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে ১৯৯৬ সালে যে ৪১ জঙ্গী ট্রেনিংরত অবস্থায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল, আবু জিহাদ তাদের অন্যতম। দুই বছর পর জামিনে কারামুক্ত হন তিনি। এরপর নিজের নাম আবু জিহাদ অনুসারে ‘ইসলামী জিহাদ আন্দোলন’ নামে একটি জঙ্গী দল গঠন করেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় খায়রুল কুরুন নামে তার একটি নিজস্ব মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসা ছাড়াও খায়রুল কুরুন ফাউন্ডেশন নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এ মাদ্রাসা থেকেই ইসলামী জিহাদ আন্দোলন ও ফাউন্ডেশনের আড়ালে জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বর্তমানে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম তেমন নেই বললেই চলে। হুজিকে সামনে রেখে জঙ্গীদের এক প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা ১৯৯৮ সালে হুজি বিলুপ্ত ঘোষণার পর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা নিলে নতুন করে আফগান মুজাহিদদের সংগঠিত করার চেষ্টা হয়। ২০০৮ সালে আফগান ফেরত মুজাহিদ কাজী আজিজুল হকের পরামর্শে ইসলামী গণআন্দোলন নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (আইডিপি) রাখা হয়। ওই সময় বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী এবং বিদেশী চক্রগুলো আইডিপিকে নির্বাচন কমিশন থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাইয়ে দিতে ব্যাপক তদ্বির করে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। ওই সময় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির শীর্ষ নেতা শাহ সিকান্দার চৌধুরীকে আইডিপিতে নেয়ার জন্য এস কে আব্দুস সালামকে বহুভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় তা আর হয়নি। পরে শাহ সিকান্দার চৌধুরী ‘কেতাল গ্রুপ’ নামে একটি জঙ্গী দল গঠন করে। দলটির প্রধান কাজই ছিল মানুষকে কতল (হত্যা) করা। আহলে হাদিস ভেঙ্গে ধাপে ধাপে জেএমবির সৃষ্টি হয় আহলে হাদিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে শায়খ আব্দুর রহমান জামা’তুল মুজাহিদীন ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ (জেএমজেবি) গঠন করেন। শায়খ আব্দুর রহমান পূর্বাঞ্চলে কাজ শুরু করেন। আর সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই রাজশাহী অঞ্চলে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে দলটি জেএমবি নাম ধারণ করে। তারা একের পর এক হত্যাযজ্ঞ শুরুর মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে শায়খ তার নিজ জেলা জামালপুরে ধর্মান্তরিত দুই খ্রীস্টানকে হত্যার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০২ সালের ১৬ আগস্ট বাগেরহাটে এক সংখ্যালঘু নেতার ওপর হামলা চালায় তারা। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা চালায়। এতে ১৯ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক। ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি জয়পুরহাটের এক পীরের দরগায় হামলা করে ৫ খাদেমকে জবাই করে হত্যা করে। একই বছর দিনাজপুরে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানায় বোমা তৈরির সময় এক জেএমবি সদস্য নিহত হয়। ২০০৩ সালের টাঙ্গাইলের সখীপুরের ফাইলা পাগলার মাজারে বোমা হামলা চালায় তারা। হামলায় তিন জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় শতাধিক। ২০০৪ সালে টাঙ্গাইলে মনির খান নামের এক লেখককে গলা কেটে হত্যা করে। তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ ইউনূসকে হত্যা করে। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদকে আহত করে। পরবর্তীতে তিনি জার্মানিতে মারা যান। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। অন্যদিকে রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুরে সর্বহারা দমনের নামে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ উল্টো করে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ঘটে। বহু কথিত সর্বহারা নেতাদের হত্যা করে সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন জেএমজেবি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর সর্বহারা দমনের নামে কথিত সর্বহারাদের হত্যার ঘটনা আরও বেড়ে যায়। ওই সময় বিএনপি-জামায়াতের তরফ থেকে বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালে জামায়াতুল মুজাহিদীন ও জেএমবি এবং জেএমজেবিকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। ধরা পড়ে শীর্ষ জঙ্গীরা। তাদের ফাঁসিও কার্যকর হয়। পরবর্তীতে জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার আতাউর রহমান সানি গ্রেফতারের পর অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করে। তার তথ্য মোতাবেক, জেএমজেবি গঠনের সময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ একসঙ্গে ২ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। এছাড়া ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) ৮ বছর ধরে কাজ করে ১২শ’ কোটি টাকা খরচ করে যুগপৎ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। এসব টাকা এসেছে বিদেশ থেকে। জামায়াতুল মুজাহিদীন, জেএমবি, জেএমজেবি ও হুজির সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংগঠন আরএসও’র (রোহিঙ্গা সলিডিরাটি অর্গানাইজেশন) ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সংগঠনগুলো আরএসও’র কাছ থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করত। আরএসও’র প্রশিক্ষিত সদস্যরা জামায়াতুল মুজাহিদীন ও জেএমজেবি এবং হুজি সদস্যদের অস্ত্র, গোলাবারুদের ট্রেনিং দিত। এসব ট্রেনিং হতো কক্সবাজার ও বান্দরবানের গহীন জঙ্গলে। জামায়াতে ইসলামী যেভাবে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয় ২০১০ সালে জেএমবির আমির জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর গ্রেফতার হয়। এরপর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, সাইদুর রহমান জাফরের জন্ম ১৯৫৯ সালের ১৪ আগস্ট হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানাধীন কুজাপুর এলাকার মিরপুরবাজার গ্রামে। পিতার নাম মৌলভী আব্দুল মতিন। মা রুজোনুন্নেছা। মৌলভীবাজার দারুল উলুম ও সিলেট দরগা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৭৭ সালে ছাত্র শিবিরে যোগ দেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ছাত্র শিবিরের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। সভাপতি অবস্থায় ১৯৮০ সালে মৌলভীবাজারের তরিকুন্নেছার সঙ্গে প্রথম বিয়ে হয়। প্রথম স্ত্রীর সন্তানরা হচ্ছেন, শামীম ওরফে সুমন (২৫), নাসিম (১৯), ফাহিম (১৭), বাশার ওরফে নাইম ও শিরিন। বাশার জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। ১৯৮১ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৮৩ সালে জেলাটির আমির ও কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য হন। দলের নির্দেশে যোগ দেন জেএমবিতে। ২০০৬ সালে তিনি জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন। সবই করেন তিনি দলের নির্দেশে। জেএমবির শতকরা ৮৫ ভাগ সদস্য ছাত্র শিবিরের। যদিও এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করে জামায়াতে ইসলামী। জেএমবি থেকে হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। তাকে বাংলাদেশের আধুনিক জঙ্গীবাদের জনকও বলা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন নব্বইয়ের দশকে তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান। সেখানেই তিনি হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে তিনি জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়াতে শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে ফেরেন। যোগ দেন পুরনো কর্মস্থলে। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মাওলা ও বেসরকারী নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক শেখ তৌফিকের মাধ্যমে উত্তরার একটি এনজিও কার্যালয়ে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিক কাযক্রম চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। দলীয় কার্যক্রম চালাতে ছাত্র শিবির নতুন দলটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ২৩৪ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের খায়রুন্নেসা ভবনের নিজস্ব ঘাঁটিতেই অফিস খুলে দেন। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে সংগঠনটি নিষিদ্ধ হয়। ২০০৯ সালে এদেশে নিষিদ্ধ হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৫৩টি দেশে সংগঠনটি নিষিদ্ধ। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলামের তৎপরতা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যার মধ্যদিয়ে জঙ্গী সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হলে বেরিয়ে আসে নানা কাহিনী। তাতে জানা যায়, জেএমবি ও হিযবুত তাহরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া বেশ কিছু সদস্য ২০০৯ সালে দলটি গঠন করে। দলটির সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন কারাবন্দী জেএমবির আমির মাওলানা সাইদুর রহমানের মেয়ের জামাই পাকিস্তানে জঙ্গী আস্তানায় পাকিস্তানী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত ইজাজ ওরফে কারগিল। মুফতি ইজাজ জামায়েতুল মুসলিমীন নামের একটি উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের বাংলাদেশ শাখার আমির ছিলেন। এ সংগঠনটির আন্তর্জাতিক আমির জর্দান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শেখ আবু মুসা আলী আররিফাই আল হাশেমী আল কোরাইশি-ই-আবু ইসা। আবু মুসা ২০০২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি প্রথম দলটির কার্যক্রম চালু করেছিলেন। ইজাজ তার মাধ্যমেই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। পরে জেএমবির আমির সাইদুর রহমানের মেয়ে বিয়ে করে জেএমবির হয়ে কাজ করছিলেন। দেশে জঙ্গী সংগঠনটির মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টাকারী বহিষ্কৃত মেজর জিয়া। এদের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০০৮ সালে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তেহজীব, রেজওয়ান শরীফ, নাফিস ও মইনউদ্দিন ইয়েমেনে গমন করে। তাদের সঙ্গে আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ঘনিষ্ঠ সহযোগী সামির খানের যোগাযোগ হয়। সেখানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ২০০৯ সালে রেজোয়ান শরিফ ইয়েমেনে গ্রেফতার হন। তেহজীব ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাকালে গ্রেফতার হন। তার ২০ বছরের কারাদ- হয়। আর নাফিস যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হয়ে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। প্রকৌশলী রাজীব থেকে শুরু করে বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা ও ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপ, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়, সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশ, প্রকৌশলী ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায়, জাগৃতি প্রকাশনার প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলায় তিন জনকে হত্যাচেষ্টা, রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও ইউএসএআইডিতে কর্মরত জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাসহ পুরোহিত, ধর্মযাজক, পাদ্রিসহ অসংখ্য খুনের ঘটনায় আনসার আল ইসলামের নামে এসব হত্যার দায় স্বীকার করে সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। নতুন জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি সর্বশেষ গুলশান হলি আর্টিজানে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যার ঘটনায় আইএসের নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। হলি আর্টিজান থেকে উদ্ধারকৃত একটি সাদা রুমালে দৌলাতুল ইসলাম নামের একটি জঙ্গী সংগঠনের নাম লেখা ছিল। সর্বশেষ সিলেটের আতিয়া মহলের দেয়ালে দাওয়াতুল ইসলাম নামে আরেক নতুন জঙ্গী সংগঠনের নাম লেখা ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এসব জঙ্গীদের দায় এড়ানোর কৌশল। মূলত সহযোগীদের গ্রেফতার এড়াতেই নতুন নাম দিয়ে রাখে। যাতে তদন্তকারী সংস্থাগুলো দিকভ্রান্ত হয়। মূলত জেএমবি ও জেএমজেবি এবং হুজিসহ সমমনা জঙ্গী সংগঠনগুলো মিলে নব্য জেএমবি নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। আর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীরসহ সমমনা জঙ্গী সংগঠনগুলো আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের সব ধর্মীয় এবং জঙ্গী সংগঠনেরই মূল টার্গেট দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা (খেলাফত) প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গবেষণা তাঁর গবেষণা মোতাবেক বাংলাদেশে জঙ্গীসহ উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের সংখ্যা ১২৫টি। এর মধ্যে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনসহ ৪০টির বিরুদ্ধে জঙ্গীবাদের যোগসূত্র থাকার অভিযোগ রয়েছে। জামায়াতে ইসলাম দেশের প্রতিটি জঙ্গী ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠনকে এখনও সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও দলটি বরাবরই এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে আসছে।
×