ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদায়ের পথে পাকিস্তানের দুই তারকা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১২ এপ্রিল ২০১৭

বিদায়ের পথে পাকিস্তানের দুই তারকা

একইসঙ্গে সমাপ্তির পথে পাকিস্তান ক্রিকেটের দুটি অধ্যায়। আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায়ের আগাম ঘোষণা দিয়েছেন মিসবাহ-উল হক ও ইউনুস খান। টেস্ট অধিনায়ক মিসবাহ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বয়সী ক্রিকেটার। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজটি আমার শেষ সিরিজ। যত দিন খেলেছি আমি সন্তুষ্ট নিজের পারফর্মেন্সে।’ তার সময়ের ক্রিকেটাররা অনেক আগেই অবসরে গেছেন। কিন্তু ২০১০ সালে স্পট ফিক্সিং কা-ে কেঁপে ওঠা পাকিস্তান দলটির নেতৃত্বভার নিয়ে আবার মর্যাদা ফিরিয়ে আনেন। অবশ্য ২০১২ সালেই টি২০ ক্যারিয়ার এবং ২০১৫ সালে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনেছিলেন। এরপরও টেস্ট খেলা চালিয়ে গেছেন। নিরাপত্তা সমস্যায় পাকরা ঘরের মাটিতে টেস্ট খেলতে পারেনি। কিন্তু দেশের বাইরে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে একের পর এক সাফল্য এনে দিয়ে পাকিস্তানকে স্বল্প সময়ের জন্য টেস্টের এক নম্বর দলে পরিণত করেন তিনি। অবশ্য গত বছর নিউজিল্যান্ড সফরে ২-০ এবং এ বছর অস্ট্রেলিয়া সফরে ৩-০ ব্যবধানে ‘হোয়াইটওয়াশ’ হলে ফের মিসবাহকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কিন্তু সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমার সময় দরকার।’ কিন্তু অবসরের আগাম সিন্ধান্ত জানিয়ে এবার তার ব্যাখ্যা, ‘আমার ক্রিকেট অভিযানটা খুবই ভাল হয়েছে। ক্যারিয়ারে অনেক কঠিন সময় এসেছিল। কিন্তু এখন সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়েই ভাবছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সিরিজের মধ্যে দিয়ে দলকে আবার জয়ের ধারায় ফেরাতে চাই। সর্বশেষ ৬ টেস্টের ফলাফল কখনও আমাদের দলের শক্তিমত্তার প্রমাণ দেয় না।’ মিসবাহ ৭২ টেস্টে ৪৫.৮৪ গড়ে করেছেন ৪৯৫১ রান। আছে ১০ সেঞ্চুরি ও ৩৬ ফিফটি। ২০০১ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অকল্যান্ডে। এরপর থেকেই দলের অপরিহার্য ক্রিকেটার হয়ে ওঠেন। নিয়মিত খেলেছেন গত ১৬ বছর। ২০১০ সালে দলের অধিনায়ক হিসেবে হাল ধরেন। গত ৭ বছর দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। গত বছরের শেষদিকে টেস্ট ক্রিকেটে দলকে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে তোলেন। ৭২ টেস্ট খেলেন তিনি। এর মধ্যে ৫৩ টেস্টেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে দলকে জিতিয়েছেন ২৪ বার, হেরেছেন ১৮ বার এবং ১১ ম্যাচ ড্র করেছেন। অন্তত ১৫ টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দেয়া পাকিস্তানী অধিনায়কদের মধ্যে সাফল্যের হারে তৃতীয় সেরা মিসবাহ। ওয়াকার ইউনুস ১৭ টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ১০ জয়ের বিপরীতে হেরেছিলেন ৭টি। তিনিই পাকিস্তানের টেস্ট ইতিহাসে সেদিক থেকে সেরা অধিনায়ক। এরপর আছেন ওয়াসিম আকরাম, তিনি ২৫ টেস্টে দলকে জিতিয়েছেন ১২ বার। চিরশত্রু ভারতের বিপক্ষে নেতৃত্ব দিতে না পারাটাই মিসবাহর বড় আফসোস, ‘এটা আমাদের হাতে নেই কিন্তু অনুতাপ হয়, আমি টেস্টে ভারতের বিপক্ষে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারিনি। বিশেষ করে আমরা যখন খুবই ভাল করছিলাম। ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপ জিততে না পারাটাও আমার ক্যারিয়ারের অপূর্ণতা।’ ২০০৭ সালের পর ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিরিজ বন্ধ হওয়ার জন্য রাজনীতিকেই দায়ী করছেন মিসবাহ। ২০১০ সালের শেষদিকে দায়িত্ব পাওয়ার পর টিম-ইন্ডিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে অধিনায়কত্ব করার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল! একদিনের ব্যবধানে এবার মিসবাহকে অনুস্মরণ করেন সতীর্থ ইউনুস খান। দেশটির টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান ও সর্বাধিক সেঞ্চুরির মালিকও জানিয়ে দেন, আসন্ন উইন্ডিজ সফরই হবে তার ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজ। ৩৯ বছর বয়সী স্টাইলিশ এ ব্যাটসম্যান বলেন, ‘আমি অবসর নেব...মাথা উঁচু রেখেই বিদায় নেব। আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর হবে আমার শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজ। প্রত্যেক ক্রীড়াবিদকেই একদিন এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হয়। আমি মনে করি, ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর এটাই সঠিক সময়। কোন রকম আক্ষেপ-অনুতাপ নেই, পাকিস্তানের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে সত্যি আমি গর্বিত।’ পাকিস্তান ইতিহাসের সর্বোচ্চ টেস্ট রান এবং সেঞ্চুরি দুটোরই মালিক তিনি। আর ২৩ রান করলে দেশটির প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করবেন। গড় ৫৩.০৬। অস্ট্রেলিয়া সফরে সিডনিতে নিজের শেষ টেস্টেও খেলেছেন অপরাজিত ১৭৫ রানের ম্যারাথন ইনিংস। বয়স চল্লিশের দোরগোড়ায় হলেও ফিল্ডিং-ফিটনেসে এখনও তরুণদের চেয়ে কম যান না। হুট করে ইউনুসের অবসরের এ সিদ্ধান্তকে তাই অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না। তবে ভেবেচিন্তেই ঘোষণাটা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি, ‘সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করে নেইনি। গত বেশ কিছুদিন এনিয়ে ভেবেছি। পরিবার, কাছের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করেছি। সত্যি বলতে যেদিন জাভেদ ভাইকে (জাভেদ মিয়াঁদাদ) ছাড়িয়ে পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ টেস্ট রানের মালিক হয়েছিলাম, সেদিন থেকেই বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে ১০ হাজারের কাছে চলে এলাম।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘অনেকেই বলতেন, ১১-১২ হাজার কিংবা, শচীনের ১৫ হাজারকে ধাওয়া করা উচিত। এসব তাদের আবেগ ও ভালবাসায় ভরা বক্তব্য। বাস্তবতা হচ্ছে, আমি সম্মান ও জনপ্রিয়তা নিয়ে সরে যেতে চেয়েছি। এটা সবার ভাগ্যে হয় না। সবসময় দেশের জন্য খেলেছি।’ ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা ইউনুসের ১১৫ টেস্টে মোট রান ৯৯৭৭। ৩২ হাফসেঞ্চুরিরর বিপরীতে সেঞ্চুরি ৩৪টি! উভয় ক্ষেত্রেই যা পাকিস্তানের হয়ে রেকর্ড। ৮৮৩২ রান নিয়ে মিঁয়াদাদ দ্বিতীয় ও ৮৮২৯ রানের মালিক ইনজামাম উল হক দ্বিতীয় স্থানে। ২৫ সেঞ্চুরি নিয়ে এ তালিকাতেও ইউনুসের পর ইনজামাম। কেবল রান আর সেঞ্চুরিই নয়, ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ব্যাটিংয়ের আরও অনেক রেকর্ডেই নিজের নামটা খোদাই করে নিয়েছেন ইউনুস। রয়েছে বিরল অনেক কীর্তিও। জানুয়ারিতেই সিডনি টেস্টে মহাকাব্যিক ইনিংসের (১৭৫*) মধ্য দিয়ে টেস্ট খেলুড়ে ১০টিসহ মোট ১১ দেশে (এবং আরব আমিরত) সেঞ্চুরির অনন্য নাজির স্থাপন করেছেন, বিশ্বে এমন কীর্তি আরও কারও নেই। ক্যারিয়ারের ৩৪তম সেঞ্চুরিটা এসেছে ৩৯ বছর বয়সে, অস্ট্রেলিয়ার মটিতে ক্লাইভ লয়েডের পর যা বেশি বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড। তিন সংস্করণেই অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা ইউনুসের অধীনে ২০০৯ সালে ইংল্যান্ড টি২০ বিশ্বকাপ জয় করে পাকিস্তান। মিসবাহর নেতৃত্বে গত বছর প্রথমবারের মতো টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠেছিল দেশটি। একসঙ্গে ব্যাটিংয়ের দুই মেরুদ-কে হারানোটা যে হবে বড় ধাক্কা, সেটি স্বীকার করেছেন প্রধান কোচ মিকি আর্থার। চলমান ওয়ানডে শেষে উইন্ডিজে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলবে পাকিস্তান। ২১ এপ্রিল জ্যামাইকায় শুরু প্রথম টেস্ট। এ সিরিজ শেষেই সাবেক হয়ে যাবেন মিসবাহ-উল হক ও ইউনুস খান।
×