ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

এটাই সঠিক সময় বলছেন মাশরাফি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১২ এপ্রিল ২০১৭

এটাই সঠিক সময় বলছেন মাশরাফি

এমন বিদায় ঘোষণা হতচকিত করেছিল সবাইকে। ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারেননি একটি ফরমেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। এবার শ্রীলঙ্কা সফরে টি২০ সিরিজ শুরুর দিনে সেই বিস্ময় উপহার দিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। জানিয়ে দিয়েছিলেন দুই ম্যাচের সিরিজটিই টি২০ ক্যারিয়ারের শেষ। এরপর আর আন্তর্জাতিক টি২০ খেলবেন না। ওয়ানডে ক্রিকেট চালিয়ে যাবেন। গত বছর থেকেই মাশরাফির অবসর গুঞ্জন উঠেছিল। কিন্তু সেসব সত্য হয়নি। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টি২০ খেলতে নামার আগে জানিয়ে দিলেন আর এ ফরমেটে খেলবেন না। দুই ম্যাচের সিরিজ শেষেই টি২০ থেকে অবসর নিচ্ছেন তিনি। মঙ্গলবার প্রথম টি২০ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টস জেতার পর মাশরাফি বলেন, ‘এ সিরিজটাই আমার শেষ টি২০ সিরিজ।’ তবে ৩৩ বছর বয়সী ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ খ্যাত এ পেসার এখন টি২০ ক্রিকেটে হয়ে গেছেন সাবেক। ৫৪ টি২০ ম্যাচে ৪২ উইকেট নিয়ে শেষ করেছেন তিনি। এর মধ্যে দলকে ২৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার অধীনে ১০ ম্যাচ জিতেছে টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ। নেতৃত্ব গুণের পাশাপাশি দলকে সংঘবদ্ধ ও উজ্জীবিত রাখার পেছনে দারুণ ভূমিকা রাখা মাশরাফি বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহানায়ক। ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের কাছে এবং ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের কাছে। ক্যারিয়ারে অনেক ইনজুরি দেখেছেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েও বোলিং-ফিল্ডিং করেছেন। অসুস্থতা, সামান্য ইনজুরি নিয়ে মনের জোরে খেলেছেন আন্তর্জাতিক ম্যাচ। আর সেগুলো বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচারে বাধ্য করেছে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। সবমিলিয়ে আটবার শল্যবিদের ছুরি-কাঁচির নিচে সপে দিতে হয়েছে নিজেকে। মাশরাফির হাঁটু হয়েছে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি যে ভালবাসা, দেশাত্ববোধের যে অনুভব সেটার ছাপ তার মধ্যে বরাবরই দেখা গেছে। তাই ক্রিকেট ছাড়েননি। অনেক আগেই বেশ কয়েকবার তার অস্ত্রোপচার করানো শৈল্যবিদ অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার ডেভিড ইয়াং বলেছিলেন, ‘খেলা ছেড়ে দিতে হবে।’ কিন্তু সেটাও শোনেননি মাশরাফি। এভাবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৬ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। তবে ২০০৯ সাল থেকে আর দীর্ঘ পরিসরের টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারেননি। আর ২০০৬ থেকে টি২০ ফরমেটে যাত্রা শুরু করেন। টানা ইনজুরির কারণে খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি ক্যারিয়ারে। ইনজুরির সময়গুলো হিসেব করলে সবমিলিয়ে প্রায় ৫ বছরই ক্রিকেটের বাইরে থেকেছেন তিনি। নয়তো ক্যারিয়ারে যে উইটেকটগুলো শিকার করতে তাতে তার নাম বিশ্বসেরাদের কাতারেই থাকত। বাংলাদেশের খেলা টি২০ সংখ্যা ৬৭। এর মধ্যে ২৮ ম্যাচেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশকে টি২০ ক্রিকেটে সর্বাধিক সাফল্যও পাইয়ে দিয়েছেন তিনিই। মাশরাফির অধীনে বাংলাদেশের জয় ১০। ১৩.৪৬ গড়ে ৩৭৭ রান করার পাশাপাশি নিয়েছেন ৩৬.৩৫ গড়ে ৪২ উইকেট। ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে অভিষেকের পর ১৬ বছর ধরে খেলেছেন মাশরাফি। আর সেই টেস্ট ক্যারিয়ারই আগে শেষ হয়ে গেছে তার। ডাক্তারদের পরামর্শে ২০০৯ সালের পর আর খেলা হয়নি টেস্ট। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে ও টি২০ অধিনায়ক তিনি। টি২০ ছাড়লেও ওয়ানডে খেলবেন মাশরাফি। ১৭২ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২২৫ উইকেট নিয়েছেন। ৩৬ টেস্টে ৭৮ উইকেট নিয়েছেন। ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে টেস্টে তার রান ৭৯৭, ওয়ানডেতে ১৫৫৬। অবসরের ঘোষণা দেয়ার সময় মাশরাফি বলেন, ‘বাংলাদেশ দলকে টি২০ ক্রিকেটে এ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিনিধিত্ব করা আমার জন্য অনেক গর্বের। আমি বিশ্বাস করি বর্তমান দলটি একটি ভাল দল এবং দলে কিছু উদীয়মান খেলোয়াড় আছে। এই সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক উত্থান-পতন ছিল। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি আমার ভক্তদের খুশি করার। আমি আমার প্রত্যেক ভক্তের কাছে তাদের প্রতি ম্যাচে খুশি করতে না পারার জন্য ক্ষমা চাইছি। আমি মনে করি টি২০ থেকে অবসর নেয়ার জন্য এটাই আমার উপযুক্ত সময় যাতে অনেক তরুণ উদীয়মান ক্রিকেটার তাদের প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ পায়। আমি বাংলাদেশের টি২০ দলের নতুন অধিনায়ককে আগাম অভিনন্দন জানাই এবং আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা সময় সামনে আসবে।’ প্রথমবার অস্ত্রোপচার হওয়ার পর যখন আর খেলতে হবে না, সেটা জেনে বেশ খুশি হয়েছিলেন। কারণ বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে থাকতে পারবেন। এমনটা বেশ কয়েক বছর ছিল। কারণ মাশরাফি নিজেই জানিয়েছেন বয়স কম থাকার কারণে টেস্ট কিংবা ওয়ানডে খেলার যে মর্যাদা সেটা বোঝার মতো উপলব্ধি ছিল না তার। এমনকি ২০০৩ বিশ্বকাপের মাঝপথে ইনজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেও খুশি হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে আবার ফিরেই ভারতের বিপক্ষে প্রথমবার ওয়ানডে জয়ের নায়ক হয়ে যান মাশরাফি ৩৯ বলে ৩১ রান করার পর বল হাতে ৩৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে। ২০০৫ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট বিজয়ের ম্যাচেও দারুণ ভূমিকা রেখেছিলেন। একই বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে জয়ের ম্যাচেও দারুণ বোলিং করেছিলেন। তবে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ক্যারিয়ারের সেরা বছর কাটিয়েছেন ২০০৬ সালে। সে বছর ক্রিকেট বিশ্বের শীর্ষ উইকেটশিকারি বোলার হন ২৭ ওয়ানডেতে ৪৯ উইকেট নিয়ে। আবার বাংলাদেশ দলও ২৮ ওয়ানডে খেলে ১৮টিতেই জয় তুলে নেয়। মাশরাফি জানিয়েছেন ক্যারিয়ারের এই বছরটা তিনি আজীবন মনে রাখবেন। আর এ বছর থেকেই ক্রিকেট একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে, উপলব্ধি করেন মর্যাদা-সম্মান, মানুষের ভালবাসার বিষয়টি। বাংলাদেশ ক্রিকেট এবং দেশের সব মানুষই মাশরাফির ভালবাসা। যার সঙ্গেই মাশরাফি পরিচিত হয়েছেন, মুহূর্তেই আপন করে নিয়েছেন এবং একেবারেই চিরাচরিত যে ভাষায় নিজের পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন সেভাবেই আলোচনা করেছেন। এ কারণেই মাশরাফির কথার বাইরে যাওয়ার কেউ নেই। দলের সতীর্থরাও তাকে মেনে চলেন অক্ষরে অক্ষরে। আর সেই সঙ্গে এত ইনজুরি নিয়েও দুর্দান্ত বোলিং করে যাওয়া ও দারুণভাবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে একের পর এক সাফল্য এনে দেয়াটা তাকে করে তুলেছে আরও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তার সরল আর ভদ্র-নম্র আচরণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ এবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে চলমান তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে। ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর আফগানদের বিপক্ষে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচ চলার সময় এক পাগল ভক্ত মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরার জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে মাঠে ঢুকে পড়ে। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মাশরাফি তাদের আটকেছেন এবং ওই ভক্তকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এজন্যই মাশরাফিকে এত ভালবাসেন। এই ভালবাসা একদিনে হয়নি। কারণ, তিনি অনেকবারই একা বাংলাদেশ দলকে জয় পাইয়ে দিয়েছেন। অধিনায়ক হলেই ইনজুরি, সে কারণেই ২০১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব আসলে প্রথম রাজি হতে চাননি। কিন্তু বাবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তা হয়েছেন। আর এরপর নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে স্বর্ণালি সময় যাচ্ছে বাংলাদেশ দলের। তার অধীনে টানা ৬ ওয়ানডে সিরিজ জয় করেছে বাংলাদেশ দল। প্রথম শ্রেণীর কোন ম্যাচ না খেলেই টেস্টে অভিষেক হয়েছিল তার। কারণ এ্যান্ডি রবার্টস তাকে চিনতে পেরে টেনে এনেছিলেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’কে। হয়ত আরও অনেক এগিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেই অন্যরকম এক উচ্চতায় থাকতেন মাশরাফি। কিন্তু ইনজুরি সেটা হতে দেয়নি। যে ১৬ বছর তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছিলেন এর মধ্যে সবমিলিয়ে অন্তত ৫ বছরই তার মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে। ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন, ভাল কিছু করার সামর্থ্যে কারও চেয়ে পিছিয়ে তো নেই-ই বরং অনেকের চেয়ে এগিয়ে, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত অপরের জন্য। সেটা এখন পর্যন্ত ফিটনেস টেস্টে প্রমাণ হয়ে যায়। দলের তরুণ ও অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন বিপ টেস্টে- প্রথমে নাম থাকে তার। সে কারণেই ক্রিকেটের ক্ষুধাটা কমে না। আর সে কারণেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহানায়ক তিনি। সেই মহানায়ককে আর দেখা যাবে না ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরমেট টি২০ ম্যাচে টাইগারদের জার্সি গায়ে।
×